৩৫ বছর আগের কথা। অন্ধকার যে কতটা গাঢ় হতে পারে, তা নিজে অনুভব করেছিলেন তিনি। জন্মলগ্ন থেকেই দৃষ্টিহীন ছিল তাঁর সন্তান। আর সেই কারণেই তিনি সাক্ষী হয়েছিলেন বাস্তবের। দেখেছিলেন, একজন দৃষ্টিহীন শিশুর ক্ষেত্রে তার পড়াশোনার পরিসর কমে যায় ঠিক কতটা। আর সে জন্যই অভিনব এক উদ্যোগে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল বই ছাপানো। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে প্রায় ৬ লক্ষেরও বেশি ব্রেইল অনুলিপি ছেপেছেন ডেবরা বন্ডে।
ব্লাইন্ডস ন্যাশনাল ফেডারেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু আমেরিকাতেই রয়েছে ১৩ লক্ষ দৃষ্টিহীন। যার মধ্যে ১০ শতাংশেরও কম মানুষ সুবিধা পান ব্রেইল-পাঠের। তার একটা কারণ যেমন ব্রেইলের দুর্লভতা, তেমনই চড়া দামের জন্যও পিছিয়ে যান অনেকে। নিজের সন্তান যখন স্কুল শিক্ষার্থী, তখন একইরকম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন বন্ডে। অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পেতেন না সন্তানের জন্য অভিপ্রেত শিশুসাহিত্যের বই।
আর এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে নিজেই এই ধরণের বই ছাপার সিদ্ধান্ত নেন বন্ডে। তবে ছাপব বললেই তো আর ছাপা সম্ভব নয়। তার জন্য শিখতে হবে ব্রেইলের ভাষা, ছাপার প্রক্রিয়াও। কাউকে না জানিয়েই তিনি ভর্তি হয়ে যান একটি প্রতিষ্ঠানে। শুধু মাত্র ব্রেইল ট্রান্সক্রিপশনের কাজ শিখতে। তারপর ডেট্রয়েটে নিজের বাড়িতেই ব্রেইল ছাপার কাজ শুরু করলেন এই মার্কিন ভদ্রমহিলা।
‘ওহ, দ্য থিঙ্কস ইউ ক্যান থিঙ্ক’ ছিল তার প্রথম কাজ। শুধু তাই নয়, অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রথম বছরেই ২২১টি বইয়ের ব্রেইল অনুলিপি প্রস্তুত করেন বন্ডে। যা শুধু তার সন্তানের জন্য নয়, বরং বিশ্বের সমস্ত দৃষ্টিহীন শিশুদের সুযোগ করে দিতেই তাঁর এই উদ্যোগ। শুধু কাগজ আর কালির দামটুকু রেখেই সেইসব বই বিক্রি করেছিলেন বন্ডে।
আরও পড়ুন
হার মেনেছে দৃষ্টিহীনতাও, স্কেটবোর্ডে ভর দিয়েই অলিম্পিকের স্বপ্ন জন্মান্ধ খেলোয়াড়ের
তাঁর এই কাজ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দৃষ্টিহীন ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক এবং শিক্ষকদের মধ্যে। আসতে থাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুদান। বাণিজ্যের উদ্দেশ্য ছিল না কোনোদিনই। কাজেই অলাভজনক একটি সংস্থা খুলে ফেলেন বন্ডে। ‘সিডলিং ব্রেইল বুকস ফর চিলড্রেন’। সাহায্যে এগিয়ে আসেন আরও অনেকে। গতি পায় তাঁর মুদ্রণ।
আজ এসে সেই বইয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লক্ষাধিক। নিজের সন্তান জ্যারেড একজন সফল সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এখন। তা সত্ত্বেও কাজ থেকে ছুটি নেননি বন্ডে। মুদ্রণ প্রক্রিয়া অব্যহত রয়েছে এখনও। গল্পের বই থেকে ছাপার পরিসর বৃদ্ধি পেয়ে তাতে ঢুকে পড়েছে পাঠ্যবই ও বিভিন্ন উচ্চশিক্ষার বইও। নিজেদের ছাপা অর্ধেক সংখ্যক বই-ই বর্তমানে বিনামূল্য প্রদান করে এই সংস্থা। বাকি বইগুলি বিক্রি হলেও, দাম থাকে ১০ ডলারের মধ্যেই। যাতে সহজেই তা কিনতে পারেন পাঠক।
আরও পড়ুন
সারমেয়-র তত্ত্বাবধানে অনুশীলন দৃষ্টিহীন কিশোরীর, লক্ষ্য প্যারালিম্পিক
পাশাপাশি বিভিন্ন বিশেষভাবে সক্ষমদের স্কুলে ব্রেইল লাইব্রেরিও গড়ে তুলেছেন এই মার্কিন মহিলা। তাতে উপকৃত হচ্ছে বহু দৃষ্টিহীন কিশোর-কিশোরী। এক কথায় এক বিশাল বিপ্লবের ভার কাঁধে বহন করে নিয়ে চলেছেন বন্ডে। সেইসঙ্গে হাত মিলিয়েছেন তাঁর পুত্র জ্যারেডও। ২০১২ সাল থেকেই এই সংস্থার পর্ষদের এক সদস্য তিনি। বর্তমানে নিজের কাজ সামলে বিভিন্ন স্কুল, কলেজে দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের জন্য বক্তৃতা দিতে যান জ্যারেড। ব্রেইল পড়তে জানা যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, ছোটদের সেই কথাই বোঝান তিনি। বিশেষভাবে সক্ষমদের জীবনের মূলস্রোতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাঁর থেকে বড়ো অনুপ্রেরক আর কে-ই হতে পারে…
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
এবার দেখতে পাবেন দৃষ্টিহীনরাও! তৈরি হল পৃথিবীর প্রথম বায়োনিক চোখ