পৃথিবীর বুকে শুক্র গ্রহের মানুষ! আজও রহস্যের অন্তরালে ডলোরিস ব্যারিওস

১৯৫৪ সালের আগস্ট মাস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট পালোমার পাহাড়ের চূড়ায় আয়োজিত হয়েছে ইউএফও কনভেনশন। এ-সম্মেলনকে বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইউএফও কনভেনশন বললেও ভুল হয় না এতটুকু। কারণ শুধু ইউএফও কিংবা ভিনগ্রহীদের নিয়ে আলোচনাই নয়, বরং মানুষের ছদ্মবেশে খোদ ভিনগ্রহীরা নাকি এসে হাজির হয়েছিল এই সম্মেলনে। তাও তারা নাকি আবার এই সৌরজগতেরই বাসিন্দা, পৃথিবীর যমজ গ্রহ শুক্র গ্রহের (Venus)।

হ্যাঁ, শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, সে-সময় গোটা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিল এই সংবাদ। কিন্তু যে সম্মেলনে ভিড় করেছিলেন হাজারেরও বেশি মানুষ, সেখানে এই ভিড়ের মধ্যে কীভাবে ‘মানবরূপী’ ভিনগ্রহীদের (Alien) চিহ্নিত করেছিলেন বিজ্ঞানীরা? 

শুরু থেকেই বলা যাক এই গল্প। পালোমার সম্মেলনের প্রধান বক্তা ছিলেন মূলত তিন জন গবেষক— জর্জ অ্যাডামস্কি (George Adamski), ড্যানিয়েল ফ্রাই, ট্র্যুম্যান বেথারাম। তিন গবেষকই তুলে ধরেছিলেন ভিনগ্রহীদের সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা কিংবা ইউএফও-র বিভিন্ন ছবি ও প্রমাণ। এর মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যকর উপস্থাপনা ছিল পোলিশ-আমেরিকান পদার্থবিদ জর্জ অ্যাডামস্কির। তাঁর দাবি, সম্পূর্ণ মানব-সদৃশ এলিয়েনদের দেখেছেন তিনি। ‘স্পেস-ব্রাদার্স’ হিসাবে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন শুক্র থেকে আসা এইসকল ভিনগ্রহীদের।

পালোমার সম্মেলনের বছর দুয়েক আগের কথা। ১৯৫২ সালের ২০ নভেম্বর কলোরাডোর মরুভূমিতে নাকি ফ্লাইং সসারে করে অবতরণ করেছিল এই ‘স্পেস ব্রাদার্স’-রা। তারপর দীর্ঘ সময় আমেরিকার বড়ো বড়ো শহরগুলিতে গা ঢাকা দিয়ে ছিল তারা। কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছিল পৃথিবীর মানুষদের। পরবর্তীতে জর্জের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাদের। গড়ে ওঠে বন্ধুত্বও। এমনকি জর্জকে পারমাণবিক যুদ্ধ এবং ভয়াবহতার ব্যাপারেও সতর্ক করেছিল তারা। 

এখানেই গল্পের শেষ নয়। এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার সঙ্গেই তিনি প্রকাশ করেন এক ভিনগ্রহীর ছবিও। তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা অনুযায়ী এই পেন্সিল স্কেচ তৈরি করেছিলেন এক মার্কিন শিল্পী। অপরাধীদের চিহ্নিত করতে গোয়েন্দারা যেমনটা করে থাকেন, অনেকটা তেমনই। 

ব্রাজিলের পত্রিকায় প্রকাশিত ডলোরিসের ছবি

 

আশ্চর্যের বিষয় হল, জর্জের বক্তৃতা শেষ হওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায় পালোমার সম্মেলনে। সেদিন সেই ভিড়ের মধ্যে দুই পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে হাজির ছিলেন এমনই এক মহিলা যাঁর মুখের গড়ন প্রায় ৯০ শতাংশ মিলে যায় জর্জের উপস্থাপিত ছবিটির সঙ্গে। বিশেষভাবে নজর কেড়েছিল, তাঁর কপালের হাড় এবং চোখের মণির অস্বাভাবিকতা। ভদ্রমহিলার চোখের মণির রং ছিল আলকাতরার মতো কালো। সঙ্গে প্রশস্ত কপাল যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে মস্তিষ্ক থেকে। স্বাভাবিকভাবেই উপস্থিত জনতা রীতিমতো হামলে পড়েছিল তাঁর ওপর। জেরা শুরু করে দেন ব্রাজিলের এক সাংবাদিক জোয়াও মার্টিন্স।

সাক্ষাৎকারে ওই মহিলা জানান, তাঁর নাম ডলোরিস ব্যারিওস (Dolores Barrios)। এমনকি তিনি জানান, সত্যিই শুক্র থেকে ভিনগ্রহীরা এসেছিল পৃথিবীতে এবং তিনি ফ্লাইং সসারে বিশ্বাসী। তবে খুব বেশি দূর এই সাক্ষাৎকার এগোয়নি। হঠাৎই ডলোরিস ও তাঁর দুই সঙ্গী দৌড় দেন নিকটবর্তী অরণ্যের দিকে। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই পালোমারের আকাশে মিলিয়ে যেতে দেখা যায় এক ফ্লাইং সসার। আর ডলোরিস?

ডলোরিসের দুই সঙ্গীর ছবি

 

প্রাথমিকভাবে উপস্থিত গবেষক এবং শ্রোতারা তন্ন তন্ন করে ডলোরিসের অনুসন্ধান করেছিলেন নিকটবর্তী অরণ্যে। পরবর্তীতে মার্কিন গোয়েন্দারাও নেমেছিলেন ডলোরিস-তদন্তে। শুধু জর্জের উপস্থাপিত স্কেচই নয়, তখন তাঁদের হাতে পৌঁছে গেছে সাংবাদিক জোয়াও-এর ক্যামেরায় তোলা ছবিও। কিন্তু লাভ হয়নি কোনো কিছুতেই। আজও রহস্যের মধ্যেই মুড়ে রয়েছে তাঁর পরিচয়, ইতিহাস।

অনেকে দাবি করেন, ডলোরিস নাকি তার পরেও পঞ্চাশ বছর জীবিত ছিলেন। ২০০৮ সালে নাকি তাঁর মৃত্যু হয়। আজীবন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বসবাস করেছেন তিনি। তবে মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তরের নথি অনুযায়ী, ডলোরিসের সন্ধান পাননি তাঁরা। ডলোরিস যদি সত্যিই মার্কিন নিবাসী হয়ে থাকতেন, তবে কি সিআইএ-র চোখ এড়িয়ে যেত বিষয়টা? 

অন্যদিকে জর্জের এই উপস্থাপনাকে অনেকেই ভুয়ো বলে দাবি করেন অনেকে। বহু গবেষকদের অভিমত, বিশ্বে শান্তি বজায় রাখার জন্যই এই মনগড়া গল্প ফেঁদেছিলেন তিনি। আমেরিকা ও সোভিয়েতের মধ্যে তখন শুরু হয়ে গেছে ঠান্ডা যুদ্ধ। দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে চাপানউতোর চলছে পুরোদমে। ঘনিয়ে উঠছে পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা। মানুষের মধ্যে সতর্কতা গড়ে তুলতে ও শান্তির বার্তা দিতেই তাই এলিয়েনের শরণাপন্ন হয়েছিলেন জর্জ। অবশ্য এই থিওরির বিপক্ষেও রয়েছেন বহু মানুষ। যাঁদের বিশ্বাস, ডলোরিস আদতে ভিনগ্রহী ছিলেন। কারণ, পালোমার সম্মেলনের পরেও একাধিকবার ভিনগ্রহীদের উপস্থিতির বিষয়ে দাবি জানিয়েছেন জর্জ। তবে এইসব বিতর্কের বাইরে আজও অন্ধকারেই রয়ে গেছে ডলোরিস-রহস্য…

তথ্যসূত্রঃ
১. Do you remember Dolores Barrios, the woman from the planet Venus?, Seig Lu, Mysteriesr Unsolved
২. Dolores Barrios: The Woman From Planet Venus, Ansh Srivastava, Infinity Explorers
৩. Dolores Barrios: An Alien in Plain Sight?, Historic Msteries

Powered by Froala Editor