বেথেলহেমের আকাশে সেদিন জ্বলজ্বল করে উজ্জ্বল এক আশ্চর্য নক্ষত্র। শুধু বেথেলহেমই নয়, অদ্ভুত এই আলোকবিচ্ছুরণ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল সুদূর প্রাচ্য থেকেই। আর এই তারাকে অনুসরণ করেই উটের পিঠে চেপে পশ্চিমে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি ব্যক্তি। বাইবেল যাঁদের চিহ্নিত করেছে ‘ম্যাগি’, ‘ম্যাজাই’, ‘কিং’ বা ‘ওয়াইজ ম্যান’ নামে। গণনা করে তাঁরা জানতে পারেন, এমন শিশুর জন্ম হয়েছে পশ্চিমে, যাঁর হাত ধরেই নাকি পাপমুক্ত হবে মানুষ।
বাইবেলের এই গল্প কম-বেশি সকলেরই জানা। জানা, হেরোডের গল্পও। কিন্তু কোথা থেকে এই তিন ‘ম্যাগি’ (Magi) হাজির হয়েছিলেন বেথেলহেমে (Bethlehem)? না, সেই সম্পর্কে স্পষ্ট করে কোনো উল্লেখ নিয়েই বাইবেলে। তবে ভৌগলিকভাবে দেখতে গেলে বেথেলহেম বা বর্তমান ইজরায়েলের পূর্ব প্রান্তের কথা উঠলে তৎকালীন পারস্য, ভারত ও চিনের প্রসঙ্গ তো আসা বাধ্যতামূলক। আরবে তখনও পর্যন্ত কোনো বড়ো জনপদ গড়ে ওঠেনি। সেখানে মূলত ছোটো ছোটো জনগোষ্ঠীর বাস। ফলে সম্ভাবনা থেকেই যায়, ভারত থেকেও হয়তো কোনো ‘বিদ্যান’ পাড়ি দিয়েছিলেন যিশুকে দেখতে।
না, শুধু সম্ভাবনাই নয়। একদল গবেষকদের বিশ্বাসও এমনটাই। তিন ম্যাগির মধ্যে একজন ছিলেন ভারতীয়। কোনো নথিগত প্রমাণ না থাকলেও, ভাষার বিশ্লেষণেই স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই ভারতীয় ‘ওয়াইজ ম্যান’-এর পরিচয়।
ম্যাথিউ-এর গসপেল অনুযায়ী, তিন ম্যাগির নাম মেলচিওর, বালথাজার এবং ক্যাসপার। এই তৃতীয় ব্যক্তিটিই ছিলেন ভারতীয়। এমনটাই অনুমান অনেকের। যিনি কিনা ছিলেন ভারতের এক রাজা। কিন্তু কীসের ভিত্তিতে এই অনুমান গবেষকদের?
সেই প্রসঙ্গে না হয় আসা যাবে একটু পরে। আপাতত ফিরে যাওয়া যাক খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের ভারতে। মৌর্য বংশের শাসনকালে পশ্চিমের আফগানিস্তান থেকে পূর্বের বাংলাদেশ পর্যন্ত প্রকাণ্ড এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন সম্রাট অশোক। তবে অশোকের পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে জৌলুস হারায় এই ‘ভারতবর্ষ’। আরও বিশেষ করে ১৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় গোটা ভারত। একদিকে যেমন দক্ষিণে উত্থান হয় চোলদের। তেমনই উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রভাব বিস্তার করে বিদেশি শক্তি। সেভাবেই উত্তর-পশ্চিম ভারতে গড়ে ওঠেছিল পল্লব সাম্রাজ্য। নেপথ্যে শকরা।
শকদের এই সাম্রাজ্য বর্তমান গুজরাট থেকে শুরু করে বিস্তৃত ছিল আফগানিস্তান পর্যন্ত। এই সাম্রাজ্যেরই অন্যতম সম্রাট ছিলেন গন্ডোফারেস (Gondophares)। আনুমানিক ১৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যিনি পল্লব সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন তক্ষশিলা থেকে।
এখন বিষয় হল, গন্ডোফেরাসই পারস্য বা বর্তমান ইরানে পরিচিত ছিলেন ‘গন্ডাপার’ নামে। আবার আর্মেনিয়ায় তাঁর পরিচয় ‘গস্টাফার’। এই গস্টাফারই যে ধ্বনি-বিবর্তনে ‘গ্যাসপার’ হয়ে গেছিল— এমনটাই মনে করেন অধিকাংশ মানুষ। এখানেই অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, কিন্তু বাইবেলে তো এই নামের উল্লেখ নেই। বরং সেখানে বলা হয়েছে ‘ক্যাসপার’।
এখানেও লুকিয়ে রয়েছে ছোট্ট একটি ধাঁধাঁ। গ্রিকরা ‘গ’-এর উচ্চারণ করেন ‘ক’। যেমন, চন্দ্রগুপ্তকেও প্রাচীন গ্রিকরা ডাকতেন ‘স্যান্দ্রোকোট’ নামে। ঠিক সেভাবেই গ্যাসপার যে ক্যাসপার হয়ে উঠেছে এমনটাই অনুমান গবেষকদের।
এখানেই শেষ নয়। মজার বিষয় হল, যিশুর ১২ জন শিষ্যের মধ্যে এক শিষ্য খ্রিস্ট ধর্ম প্রবর্তন করতে চলে এসেছিলেন ভারতে। সেন্ট থমাস নামের এই সন্ত পরিচিত ‘ডাউটিং থমাস’ হিসাবে। তার কারণ, তিনিই প্রথম প্রশ্ন তুলেছিলেন যিশুর পুনরুত্থান বা রিইনকারনেশন নিয়ে। সে যাই হোক, ৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি দক্ষিণ ভারতে (বিশেষত কেরলে) প্রথম গির্জা নির্মাণ করেন এমন কথাও আছে বিভিন্ন নথিতে। এমনকি আলেকজান্দ্রিয়ায় পাওয়া এক নথিও বলে ভারত ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। তবে শুধু দক্ষিণ ভারতই নয়, সে-সময় নাকি তিনি গন্ডোফারেসকেও দীক্ষিত করেন খ্রিস্টধর্মে। ফলে, গন্ডোফারেসের সঙ্গে যে খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই কোনো। এবং পরবর্তীতে গন্ডোফারেসের প্রবর্তিত একাধিক রৌপ্যমুদ্রাও পাওয়া গেছে তক্ষশীলা থেকে। ফলে, গন্ডোফারেস যে কাল্পনিক রাজা— এমনটাও নয়।
অবশ্য একদল গবেষক এই মতবাদে বিশ্বাসী হলেও, বিরোধিতা করেন আরেকদল গবেষক। তাঁদের মতে বাইবেলে যে ‘কিং’-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাঁরা কোনো রাজা নন। বরং, জ্যোতিষী বা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। ‘ম্যাজাই’ কথাটির ইংরাজি অনুবাদের সময়ই তা বদলে গিয়েছে ‘কিং’-এ। ফলে, শুরুতেই গন্ডোফারেসের বেথেলহেম-ভ্রমণের সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায় সেই যুক্তিতে। সবমিলিয়ে ভারতীয় এই রাজা আদৌ বেথেলহেমে হাজির হয়েছিলেন কিনা, তা নিয়ে থেকেই গেছে রহস্য। তবে আগামীতে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের আবিষ্কার এই বিতর্কে ইতি টানবে, এমনটা আশা করাই যায়…
তথ্যসূত্রঃ
১. Gondophares, wikipedia
২. Thomas the Apostle, wikipedia
৩. Gondophares : India's Biblical Connection, livehistoryindia
৪. The Magi Kings, Goan Churches
Powered by Froala Editor