বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে (চতুর্থ পর্ব)

আদিদেব মুখোপাধ্যায়
দি উইন্ড উইল ক্যারি আস
আব্বাস কিয়ারোস্তামি
ইরান, ১৯৯৯    

সে গোরুর দুধ দুইছে। তার মাথাটি হিজাবে ঢাকা।
মৃত মহিলা কবি ফারুখ ফারুখজাদের একটি কবিতা সাংবাদিক আবৃত্তি করতে থাকে, মেয়েটিকে হয়তো কিছুটা ইম্প্রেস করার জন্যেই।
কবিতাটি প্রেমের।

দুই যুগলের প্রণয় - এক নারীর মুখে ব্যক্ত হচ্ছে আবেগ থরোথরো ভাষায়।
অত্যন্ত রোমান্টিক সব ইমেজ।

এই প্রায় অন্ধকার, বিদ্যুৎহীন গোয়ালঘরে এই কবিতা একেবারেই বেমানান ঠেকে প্রথম দর্শনে।
কিন্তু এই গোয়ালঘরই আমাদের স্বর্গের সেনসেশন দিয়েছে একটু আগে।
মেয়েটি দুটি সত্তা পেয়ে গেছে এবার - এক/ সে এক জন গ্রাম্য সরল ষোলো বছরের মেয়ে যে পাঁচ বছর ধরে ইশকুলে যাচ্ছে।

দুই/ এ এক স্বর্গীয় মানবী, শাশ্বত চরিত্র, এক রহস্যময়ী, যে কিছুতেই তার মুখ দেখাবে না। সে যেন ইতিহাসের চরিত্র হয়ে ওঠে, একই সঙ্গে হয়ে ওঠে পৌরাণিক চরিত্রও।

সাংবাদিক মেয়েটিকে জিগ্যেস করে, সে কি ফারুখের নাম শুনেছে?
মেয়েটি উত্তর দেয়, হ্যাঁ, প্রতিবেশীর মেয়ে ফারুখকে সে চেনে।
সাংবাদিক কবি ফারুখের কথা বলতে চেয়েছিল। ইরানের নারীবাদী কবি, ফিল্মমেকার ফারুখ ফারুখজাদ।
যিনি এখন মৃত।

কিন্তু মেয়েটি ফারুখের যে অর্থ করেছে তাতে 'ফারুখ' একটি স্থির চিহ্ন না থেকে চলমান রাশিতে পরিণত হয়।
এখানে ফারুখ, একই সঙ্গে ইরানের কবিতালেখক, অগ্রগণ্য নারী চরিত্র, আবার সাধারণ মেয়েও।
এই ছোট্টো সংলাপটি তার নিজস্ব সূক্ষ্মতা নিয়ে হয়ে ওঠে রাজনৈতিক।
ইরানের প্রতিটি গ্রামে, শহরে এমন ফারুখেরা আছে।

মেয়েটি দুধ দোয়া হয়ে গেলে সাংবাদিককে প্রশ্ন করেঃ এই ফারুখ স্কুলে কত ক্লাস অবধি পড়েছে।
সে এই মহিলা কবিতালেখকের প্রতি প্রায় সহপাঠিনীর আত্মীয়তা অনুভব করছে।
কিয়ারোস্তামি নারীর বয়ানকে শুনতে দিচ্ছেন পুরুষের কণ্ঠে, তারপরেই শ্রোতা মেয়েটিকে অনুপস্থিত, মৃতা নারীটির প্রতি দরদী করে তুলছেন।
একেবারেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

মেয়েটি তার মাকে বারণ করে সাংবাদিকের কাছ থেকে টাকা নিতে, মা তখন সাংবাদিককে ডেকে টাকা ফিরিয়ে দেন।
অপূর্ব মাধুর্য নিয়ে মেয়েটি আমাদের মনে ও হৃদয়ে থেকে যায়। তার মুখ আমরা একবারও দেখতে পাই না।

আবার একটা দিনের শেষ, রাত্রি এবারেও দেখানো হয় না।
সাংবাদিক দাড়ি কামাচ্ছে, দিনের শুরু।

বালক ফারজাদকে সাংবাদিক ব্যক্তিগত হতাশা থেকে বকাঝকা করে।

সাংবাদিকের আবার ফোন আসে, সে গাড়ি নিয়ে ছোটে উঁচু জায়গার দিকে। একই নিসর্গ, একই ফ্রেম, একই বাস্তবতা ছবিতে ফিরে আসতে থাকে।

বসের স্ত্রীর সাথে কথাবার্তা অত্যন্ত হতাশাজনক হয়।

সাংবাদিক সেই কবরস্থানের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সে দেখে, একটা প্রাচীন কচ্ছপ একটি সমাধি প্রস্তরের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
আব্বাস আবার মৃত্যুর সিম্বল  ফিরিয়ে আনেন- সমাধিপ্রস্তরের গায়ে ফারসি অক্ষরে লেখা এপিটাফ।

কচ্ছপ, যে তিনশো বছর বাঁচে, সে মৃতের স্মৃতিচিহ্নের ওপর দিকে হেঁটে যাচ্ছে।
প্রাচীন জীবন, জীর্ণ জীবন আর মৃত্যুর সোপানের সংলাপ চলতে থাকে নিরুচ্চারে।

কচ্ছপটিকে সাংবাদিক প্রায় ধর্ষকামী মন থেকে উলটে দেয়। শিশুরা এই ধরনের খেলা খেলে আমরা দেখেছি। সাংবাদিক, প্রাপ্তবয়স্ক ও নাগরিক মন দিয়েও  শিশুসুলভ কিন্তু নির্দয় নিষ্ঠুরতা করে একটি নিরীহ প্রাণীর সাথে।
কচ্ছপটিকে ফেলে রেখে সে গাড়ি চালিয়ে চলে যায়।

কচ্ছপটি কিন্তু নিজে নিজেই সোজা হয়, আবার চলতে থাকে।

এতক্ষণ সাংবাদিকই ছিল ন্যারেটিভের সূত্রধর, এবার ন্যারেটিভ ছাপিয়ে অতিরিক্ত কিছু জিনিস আব্বাস অন্তর্গত করেন ছবিতে। মূল ন্যারেটিভটি যেন সাংবাদিকের সঙ্গেই গাড়ি করে বেরিয়ে গেছে, আব্বাস সেই ন্যারেটিভের সঙ্গে অতিরিক্ত, সহানুভূতিশীল, নিবিড় পর্যবেক্ষণে ধরা পড়া এই পুনরুত্থানের দৃশ্যটি সেলাই করে দেন।
শুধু মানুষের জন্মমৃত্যু ছাপিয়ে সমগ্র প্রাণমণ্ডলকে এই ছবি দেখতে থাকে, শিখতে থাকে তার কাছে, অনুধাবন করতে থাকে।  
কচ্ছপও মরল না। বৃদ্ধাও মারা যাচ্ছেন না। তাহলে কি সাংবাদিকের উদ্দেশ্য ভেস্তে যাবে?

পরদিন।
 ফারজাদের সঙ্গে সাংবাদিক কথা বলছে , তার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে। সাংবাদিক নিজের মাথা গরমের জন্য অনুতপ্ত, সে বলেঃ মেশিন যেমন অতিরিক্ত কাজ করলে খারাপ হয়ে যায়, মানুষেরও তাই হয়।
ফারজাদ জানায়ঃ তা তো নয়, সাংবাদিক তো সারাদিন কোনো কাজই করেনি।
সাংবাদিক বলেঃ কুঁড়েমি থেকেও এমন মাথা গরমের ঘটতে পারে।
আসলে  নাগরিক ডিপ্রেশনের বিষয়টা গ্রাম্য বালক ফারজাদের জানার কথাই নয়, আমরা বুঝি।

সাংবাদিক ফের ফোন পেয়ে ছুটছে উঁচু জায়গায়, একই দৃশ্য, একই ফ্রেম ফিরে আসছে। সাংবাদিক সেই সমাধিস্থানের কাছে চলে আসে, গাড়ি থামায়।

সে যখন গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, আমরা গাড়ির ড্যাশবোর্ডে রাখা হাড়টিকে খেয়াল করি।

একটি পোকা, তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমরা দেখি, একটা গুটি নিয়ে একটি পোকা চলেছে কাঁকড়ে ভরা জমি দিয়ে।
গুটির চাপে পোকাটি বেসামাল।
একটি ছোট্টো গর্তে পোকাটি পড়ে যায়।
সে আর গুটিটা তুলতে পারে না।
দৃশ্যটি দেখে সাংবাদিকের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
এখানেও আব্বাস (আগে যেমন ছিল আপেলের বেলায়) একটি ক্ষুদ্র পতঙ্গকে অধিকার দেন নিজের ন্যারেটিভ গড়ে পিটে নিতে। যদি পোকাটি গর্তে না পড়ত, তাহলে সাংবাদিকের মুখে হাসি ফুটত না, তার চোখ ঐ পোকাটিকেই অনুসরণ করে চলত।
এই সময় একটি শব্দ আসে, সাংবাদিক মুখ ফিরিয়ে দেখে, গর্তে ঐ খননকারী ব্যক্তিটি ধস নেমে যাওয়াতে চাপা পড়ে গেছে।

এই প্রথম গর্তটিকে আমরা সামনে থেকে (অর্থাৎ ওপর থেকে) প্রত্যক্ষ করি। ‘ওপারে’র সোপানকে প্রথম চাক্ষুষ করি।
কিন্তু সেই সোপানটি অবরুদ্ধ,  মানুষটি কি বেঁচে আছে? ধুলোতে আমাদের দৃষ্টি ঢাকা পড়ে যায়।
সাংবাদিক এবার ছোটে গাড়ি নিয়ে- এবার তার অপেক্ষা ও উদ্বেগ শুরু হয় অন্য কারণে, বিপ্রতীপ কারণে - একটি মানুষকে সে এবার বাঁচাতে চলেছে।
সাংবাদিক লোক জড়ো করে মানুষটিকে উদ্ধার করতে যায়।

এই সময় ফারজাদের বন্ধুরা ন্যারেটিভে ঢুকে পড়ে।

সাংবাদিক লিফট দিতে চাইলে বন্ধুরা উঠে এলেও ফারজাদ ওঠে না। বোঝা যায় সে এখনও রেগে আছে।
ব্যাকসিটে কচিদের কলরব যেন জীবনের বহমানতার চিহ্ন হয়ে যায়, এদিকে গাড়িটা উদ্বেগ বহন করে নিয়ে চলেছে- একটি মানুষ বাঁচবে কিনা, নির্ভর করছে তার দ্রুতির ওপরে।
সাংবাদিক নিজের বন্ধুদের খুঁজে পায় না, কচিদের নামিয়ে দেয়।
গর্তের কাছে ফিরে আসে।

আহত মানুষটিকে রাখা হচ্ছে গাড়ির মধ্যে, তার পায়ের পাতাদুটির তলা আমরা খালি দেখতে পাই।
তার শরীরের আর কিছুই আমাদের দৃষ্টি গ্রাহ্য হয় না।

মৃত্যুর চিহ্ন – পায়ের পাতার তলা।

(ক্রমশ)