Powered by Froala Editor
মুণ্ডহীন ছাগল নিয়ে ‘পোলো’, আফগানিস্তানের জাতীয় খেলাতেও নৃশংসতার ছাপ
১/১২
ঘোড়ায় চড়ে সারামাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়। হাতে ধরা কাঠের স্টিক। লক্ষ্য, ছোট্ট কাঠের বলকে গোললাইন পার করানো। হ্যাঁ, পোলোর কথাই হচ্ছে। কম-বেশি সকলেই পরিচিত এই খেলার সঙ্গে। কিন্তু ছোট্ট ওই কাঠের বলের বদলে যদি ব্যবহার করা হয় আস্ত মুণ্ডহীন একটি ছাগলের মৃতদেহ?
২/১২
শুনেই গা ঘিনঘিন করে উঠছে নিশ্চয়ই? আর সেটাই স্বাভাবিক। তবে বাস্তবেই এমন নৃশংস এবং হিংস্র খেলার অস্তিত্ব রয়েছে পৃথিবীতে। আর ‘বুজকাশি’-খ্যাত এই খেলাই আফগানিস্তানের জাতীয় খেলা। তাছাড়াও কিরজিগস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান-সহ মধ্য এশিয়ার একাধিক দেশেই বেশ জনপ্রিয় খেলা বুজকাশি।
৩/১২
পশতো ভাষায় ‘বুজকাশি’-র অর্থ হল ‘ছাগল ধরা’। আক্ষরিক অর্থেই, এই খেলা মৃত ছাগলের দেহ দখলের লড়াই। আফগানিস্তানের ধূলিধূসরিত মরুপ্রান্তরে গোলাকার মাঠে সাধারণত খেলা হয় বুজকাশি। মাঠের দু’প্রান্তে থাকে বৃত্তাকার গোল (Goal)। সেখানে মৃত ছাগলটির দেহ পৌঁছে দিতে পারলেই পয়েন্ট বরাদ্দ হয় সংশ্লিষ্ট অশ্বারোহী কিংবা দলের জন্য। এভাবেই খেলা চলতে থাকে রাউন্ডের পর রাউন্ড।
৪/১২
সাধারণত, ঘণ্টা দুয়েক ধরে চলে ছাগল নিয়ে কাড়াকাড়ি-রক্তারক্তির এই খেলা। আধুনিক সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই এই সময়সীমা। একটা সময় প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলত বুজকাশির এক একটি ম্যাচ।
৫/১২
আর পুরস্কার? দিনের শেষে খেলার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছাগদেহটিই ট্রফি হিসাবে পায় বিজয়ী দল। পাশাপাশি, বাজি ধরার টাকা থেকে একটা বড়ো অংশ বরাদ্দ হয় তাঁদের জন্য। এর বাইরে প্রতি রাউন্ডে গোল করতে পারলে, সংশ্লিষ্ট গোলদাতার জন্য থাকে কাঁচা টাকার ইনাম।
৬/১২
তবে নৃশংস হলেও, বুজকাশির ম্যাচ দেখতে রীতিমতো ভিড় জমে যায় মাঠে। ঘোড়দৌড়ের মতো বুজকাশিকে কেন্দ্র করে চলে দেদার বাজি ধরাও। মূলত, অভিজাত আফগান এবং উকবেক যুদ্ধবাজরা বিপুল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেন এই খেলায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, খেলার মাঠের বাইরে বুজকাশি রাজনৈতিক ক্ষমতাপ্রদর্শনের মাধ্যমও বটে।
৭/১২
তবে এই খেলার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘ এক ইতিহাস। ত্রয়োদশ শতকের শুরুর দিক সেটা। আফগানিস্তান তখন চেঙ্গিস খানের দখলে। কিন্তু ভৌগলিক অবস্থানের জন্য, মধ্য এশিয়ার এই দেশের ওপর লোলুপ দৃষ্টি ছিল অন্যান্য শক্তিদেরও। ফলত, যোদ্ধাদের জন্য কঠিনতম অনুশীলনের বন্দোবস্ত করেছিলেন চেঙ্গিন খান। সে সময়ই যুদ্ধশিক্ষার অঙ্গ হিসাবেই জন্ম নেয় বুজকাশি। তারপর ধীরে ধীরে তা মিশে যায় আফগান ঐতিহ্যে।
৮/১২
বিশেষত উত্তর আফগানিস্তানের শেবেরগান শহরে শীতকাল পড়লেই জাঁকিয়ে বসে বুজকাশির আসর। এই সময়টা আফগানিস্তানে ‘বুজকাশি মরশুম’ হিসাবেই পরিচিত। প্রতি শুক্রবার দুপুর গড়ালেই শুরু হয়ে যায় নৃশংসতার খেলা। মাঠে দর্শকদের ভিড় তো থাকেই। পাশাপাশি আফগান টেলি-চ্যানেলেও সম্প্রচারিত হয় বুজকাশির লড়াই। স্থানীয়দের কাছে খেলার খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য, মাঠে ব্যবস্থা থাকে মাইকিং-এরও।
৯/১২
বুজকাশি খেলাটির সঙ্গে পোলো’র অনেক মিল থাকলেও, এই খেলা একেবারেই অভিজাতদের জন্য নয়। কুস্তিগিরদের মতো রীতিমতো মুগুর ভাঁজতে হয় বুজকাশি যোদ্ধাদের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে হয় জিমে। সেইসঙ্গে ক্ষিপ্রতা বৃদ্ধির জন্য কঠিন অনুশীলন তো রয়েইছে। প্রায় ১০০ পাউন্ড ওজনের মৃত ছাগলের দেহ এক হাতে ধরে অশ্বারোহণ তো আর মুখের কথা নয়।
১০/১২
তবে শুধু বুজকাশি যোদ্ধাদের পারদর্শিতাই শেষ কথা নয় এই খেলায়। বুজকাশিতে বাজিমাত করতে দরকার পড়ে শক্তপোক্ত ঘোড়ারও। আর তা আমদানি করা হয় মূলত উজবেকিস্তান থেকে। বুজকাশির জন্য উপযুক্ত এক-একটি ঘোড়ার দাম প্রায় ৫০ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। যদিও এই অর্থমূল্য নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে হয় না খেলোয়াড়দের। সাধারণত, আফগান পুঁজিপতি এবং যুদ্ধবাজরাই তা স্পনসর করে থাকেন।
১১/১২
অবশ্য, একটা সময় বুজকাশির জন্য সবথেকে পারদর্শী ঘোড়ার সন্ধান মিলত আফগানিস্তানেই। তবে বিশ শতকের গৃহযুদ্ধের সময় বদলে যায় পরিস্থিতি। গুঁড়িয়ে যায় অসংখ্য ব্রিডিং সেন্টার। তবে দেশের পরিকাঠামো ভেঙে পড়লেও থেমে থাকেনি ঐতিহ্যবাহী এই খেলা।
১২/১২
সম্প্রতি, তালিবান আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর বার বার চোখের সামনে উঠে আসছে নৃশংস দৃশ্য। গুলি করে সঙ্গীতশিল্পীকে হত্যা করা থেকে শুরু করে, মহিলাদের ওপরে পাশবিক অত্যাচার— বার বার ফুটে উঠে সেই করুণ দৃশ্য। তবে এই পাশবিকতা আজকের নয়। বরং, আফগানিস্তানের বুকে তা বাসা বেঁধে রয়েছে শতকের পর শতক ধরে। বুজকাশি যেন মনে করিয়ে দেয় সেই কথাই…