কোভিড-১৯ অতিমারীর মধ্যেই পার হয়ে গেল আরও একটি শিক্ষক দিবস। অতিমারীর কারণে বেশ কয়েক মাস ধরেই বন্ধ রয়েছে প্রচলিত শিক্ষাক্ষেত্রগুলি। বদলে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস শুরু হয়েছে অনলাইনে। তার মধ্যেই বিতর্ক বেঁধেছে বিভিন্ন পরীক্ষা নেওয়ার জন্য সরকারের একগুঁয়েমিতে, অথবা, অনলাইন পড়াশোনার পর পরীক্ষা ব্যবস্থাও অনলাইনে নিয়ে আসার জন্য। সব মিলিয়ে এই লকডাউন সময়কালে বারবারই আলোচনা বা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে শিক্ষা ব্যবস্থা। তাই এই শিক্ষক দিবসের দিনে একবার ঘুরে তাকানোই যায় দেশের শিক্ষকদের বর্তমান পরিস্থিতিটা ঠিক কেমন, সেই দিকে।
করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাক্ষেত্রগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছু ছবি ঝলক দিয়ে উঠেছিল মিডিয়াতে। তামিলনাড়ুর মুন্নারে অনলাইন ক্লাস নেওয়ার জন্য নেটওয়ার্ক কানেকশন পেতে এক শিক্ষকের ছাদে উঠে ক্লাস নেওয়ার ছবি নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের। ভীষণ রোদ থেকে বাঁচতে একহাতে মাথায় ধরা ছাতা। কিংবা মুম্বইয়ের এক অঙ্কের শিক্ষিকা রেফ্রিজারেটরের ট্রে ব্যাবহার করে খাতায়-কলমে অঙ্ক শেখাচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রীদের, এই ছবিও ভাইরাল হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। তার সঙ্গেই ভেসে উঠেছিল আরও কিছু ছবি, যেখানে হায়দ্রাবাদে এক শিক্ষককে দেখা গিয়েছিল অর্থের অভাবে রাস্তায় কলা বিক্রি করতে। কিংবা দিল্লির এক ইংরেজি শিক্ষককে দেখা গিয়েছিল মুখে মাস্ক বেঁধে সবজি বিক্রি করতে রাস্তায়। পাঞ্জাবের একদল শিক্ষককে রাস্তায় বেরিয়ে এসে আন্দোলন করতে হয়েছিল অবিলম্বে শূন্যস্থান পূরণের জন্য। সব মিলিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রের টালমাটাল পরিস্থিতিটা চুম্বকে এই সমস্ত ছবিগুলিই।
এই গ্রহের কোনও জনবসতি, প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোগ রেহাই পায়নি এই অতিমারীর হাত থেকে। বলাবাহুল্য, শিক্ষাক্ষেত্রও এর বাইরে নয়। বরং পরিস্থিতিটা আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে শিক্ষক এবং ছাত্র, উভয় গোষ্ঠীর কাছেই। বিশেষ করে একটু বেশি বয়সের শিক্ষক গোষ্ঠীর কাছে খুবই সমস্যার হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান পরিস্থিতি। নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ অথবা অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার মতো উপকরণ না থাকার জন্য রাতারাতি এই শিক্ষা ব্যবস্থা ভীষণই কঠিন করে তুলেছে শিক্ষকদের কাজ। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৪টি দেশের প্রায় ১৬০ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই লকডাউনের সময়ে। স্কুল ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার ফলে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলিতে সরাসরি প্রভাবিত হয়েছে ৯০ শতাংশেরও বেশি ছাত্রছাত্রী। শিক্ষার্থীদের পাঠ চালু রাখতে অনেক প্রতিষ্ঠানই অনলাইনে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া চালু করেছিল। কিন্তু উন্নত দেশগুলিতে যেখানে প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী অনলাইন শিক্ষার আওতায় আসতে পেরেছিল, সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই পরিসংখ্যান নেমে আসে মাত্র ৫০ শতাংশে। এর অন্যতম কারণ ছিল এই উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শিক্ষকদের অনলাইন প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞতা।
গত এপ্রিল মাসে ভারতে গ্রামীণ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট পরিষেবা সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা চালানো হয়। তাতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, অনলাইন শিক্ষা প্রদান করার মতো সুব্যবস্থা গড়ে উঠতে ঢের দেরি এখনও। সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, দেশে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি লোকেরা মোবাইল ফোনের হটস্পটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। কেবলমাত্র ১৫ শতাংশের বাড়িতে ব্রডব্যান্ড লাইনের সুবিধা আছে। এই ১৫ শতাংশের অর্ধেকেরও বেশি ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সমস্যা দেখা দিয়েছিল এবং এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে সিগন্যাল সংক্রান্ত সমস্যা ছিল। সুতরাং নিম্নমানের ইন্টারনেট পরিষেবা ভারতে অনলাইন শিক্ষার জন্য একটি বড় বাধা, তা কার্যত অনস্বীকার্য।
আরও পড়ুন
বাড়ি গিয়ে ক্লাস করাচ্ছেন স্কুল শিক্ষকরা, শিক্ষাব্যবস্থার অভিনব ছবি সিকিমে
এছাড়াও শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে প্রথাগত শিক্ষণ শৈলীর বাইরে উন্নত এবং আধুনিক শিক্ষা শৈলী গ্রহণের ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব। বস্তুত, শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রটিকে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা করে এসেছে সরকার। প্রশিক্ষণের সুযোগ-সুবিধা থাকলেও সেগুলিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে না পারার জন্য সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে আরও বেশি।
সাম্প্রতিককালে ভারতের জিডিপি কমে দাঁড়িয়েছে ২৩.৯ শতাংশ, যা ঐতিহাসিকভাবে কম। এর অভিঘাত সরাসরি শিক্ষাক্ষেত্রে পড়ার সম্ভাবনা একশো শতাংশ। অর্থাৎ সরকারের পক্ষে দেশের শিক্ষার মান পুনরুদ্ধারের পথ কিন্তু সহজ হবে না। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দা দেখিয়েছে যে, অন্ততপক্ষে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি অর্থানুকূল্য পূর্ববর্তী মন্দার সমপরিমানে থেকে যায়। ফলে শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি লাভের মুখ দেখার জন্য টিউশন ফি বৃদ্ধি করে, সীমিত করে দেয় গ্রন্থাগার এবং কম্পিউটার ল্যাব পরিষেবা। সর্বোপরি, চিরাচরিতভাবে কোপ পরে শিক্ষকদের বেতন অথবা সরাসরি চাকরির উপর।
আরও পড়ুন
প্রতিদিন খাবার রেঁধে ৮৫ জন পড়ুয়ার বাড়িতে পৌছে দিচ্ছেন ইংল্যান্ডের শিক্ষক
কিন্তু কোনও আলোর দিশাই কি নেই? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই সুযোগ থাকলেও তা হারিয়েছি আমরা। এই লকডাউন অথবা মন্দা পরিস্থিতিকে একটি হাতে পাওয়া সুযোগ হিসেবে দেখলেও কিন্তু দেখা যেতে পারত। এই সময় প্রশাসনিক সংস্কারের পাশাপাশি শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক দক্ষতা বাড়াতে এবং উন্নত শিক্ষার উপকরণের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে ব্যবস্থা করতে পারত সরকার। কিন্তু এই প্রচেষ্টা বিশেষ দেখা যায়নি।
সম্প্রতি ৬৭টি দেশের ৯৩টি শিক্ষক ইউনিয়নের উপর করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষক বেতন কমানো, দেরিতে অর্থ প্রদান, চুক্তি পুনর্নবীকরণ না হওয়ার মতো কারণে সরাসরি প্রভাবিত হয়েছিলেন। সুতরাং, শুধু শিক্ষক দিবসের দিন এলেই শিক্ষকদের শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি থেকে যাচ্ছে একটা অন্ধকার দিকও। সেই অন্ধকার দীর্ঘকালীন। যতক্ষণ না পর্যন্ত আলো পড়ছে সেই অন্ধকারে, ততক্ষণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও কিন্তু বঞ্চিত থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছেই। তাই সবার আগে দরকার শিক্ষকদের সামাজিক ও মানসিক কল্যাণের কথা মাথায় রেখে একটি জাতীয় স্তরের নীল-নকশা প্রস্তুত করা। এই শিক্ষক দিবসে আমাদের জীবনের আলোর কাণ্ডারীদের জন্য এটুকু তো আশা রাখতেই পারি আমরা।
আরও পড়ুন
বাড়ির বাগানে ২০০ উদ্ভিদের পরিচর্যা, লকডাউনে সবুজ পৃথিবীর পাঠ দিচ্ছেন হায়দ্রাবাদের শিক্ষক
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor