১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। হ্যাঁ ১৯ বছর পেরিয়ে গিয়েছে ঠিকই, তবে তারিখটা আজও মানুষের স্মৃতিতে একেবারে মলিন হয়ে যায়নি। মার্কিন বিমান বাহিনী থেকে ৪টি বোয়িং বিমান হাইজ্যাক করে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার তছনছ করে ফেলেছিল ১৯ জন তালিবানি জঙ্গি। সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল সবচেয়ে উঁচু দুই অট্টালিকা, যাদের একসঙ্গে টুইন টাওয়ার বলেও জানতেন সকলে। শুধু অট্টালিকাই নয়, ভেঙে পড়েছিল আমেরিকার অর্থনীতির মেরুদণ্ডটাই। কিন্তু ঠিক সেইদিনই রাতে ওভাল অফিস থেকে জানানো হয়, জঙ্গি হামলা দেশের সবচেয়ে বড় অট্টালিকার ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু দেশের ভিত নাড়াতে পারবে না। সেটা যে পারেনি তা আজ ১৯ বছর পরে দিব্যি বোঝা যায়। কিন্তু এর মধ্যেও যে অসংখ্য মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই মিশে আছে, তার সমস্ত খবর কী রেখেছি আমরা?
০৯/১১-র হামলার পরে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল ওয়াল স্ট্রিটের বিভিন্ন অফিস। আর তার ফলে শুধু আমেরিকা নয়, পৃথিবীর নানা দেশের অর্থনীতির উপর তার প্রভাব পড়েছিল। আমেরিকার অর্থনীতি রাতারাতি ৭.১ শতাংশ নিচে নেমে যায়। কাজ হারায় ১ লক্ষ ৪৩ হাজার মানুষ। কিন্তু এ-তো গেল শুধু অর্থনীতির প্রভাব। সেইসঙ্গে অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী হামলায় যা হয়, এখানেও হল তাই। মারা গেলেন অসংখ্য মানুষ। যে ১৯ জন সন্ত্রাসবাদী হামলা চালিয়েছিলেন তাঁরা আত্মহত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই গিয়েছিলেন। তাঁদের নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা ছিল সরকারি হিসাবে ২৭৬৩। এর মধ্যে ছিলেন দমকলকর্মী, পুলিশ সহ ট্রেড সেন্টারের বহু কর্মী।
এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইটা সহজ ছিল না। কিন্তু সেদিন সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। রাতারাতি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। আল-কায়দার তরফ থেকে হামলার দায় ততক্ষণে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বুশ জানিয়ে দিয়েছিলেন, সমস্ত সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধেই লড়াই চালিয়ে যাবে আমেরিকা। আজও সেই দায়বদ্ধতা বহন করে চলেছে মার্কিন বাহিনী। এখন অবশ্য সেনাবাহিনীতে যে নতুন প্রজন্ম যোগ দিতে চলেছে, তাদের অনেকেই ট্রেড সেন্টার আক্রমণের সময় রীতিমতো শিশু ছিলেন। ফলে তাঁদের স্মৃতিতে সেভাবে কিছুই নেই। কিন্তু এটুকু প্রত্যেকেই জানেন, সন্ত্রাসবাদ তাঁদের দেশকে চুরমার করে দিতে চেয়েছিল।
০৯/১১ হামলার পরিপ্রেক্ষিতেই আমেরিকা সরকার গড়ে তোলে ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড অ্যান্ড সিকিওরিটি। সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে দেশের যাবতীয় সুরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই বিভাগের উপরেই। কিন্তু তার থেকেও বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল, সেই আক্রমণে বিপর্যস্ত বহু মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। কর্মহীন মানুষদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করা। আর সেই ভেঙে পড়া অট্টালিকা থেকে ছড়িয়ে পড়া বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া মানুষদের উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
২০১৮ সালের পরিসংখ্যান পর্যন্ত মোট ১০ হাজার মানুষের ক্যানসারের কারণ হিসাবে চিকিৎসকরা দায়ী করেছেন ০৯/১১ হামলাকেই। শুধু ক্যানসারই নয়, শ্বাসযন্ত্র এবং হৃদযন্ত্রের সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছিলেন আরও অসংখ্য মানুষ। আমেরিকা সরকার তাঁদের প্রত্যেকের চিকিৎসার দায়িত্ব ঘোষণা করেছিল। সেই উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়েছিল ভিকটিম কম্পেনসেসন ফান্ড। ২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৭ বিলিয়ন ডলারের তহবিল মঞ্জুর করা হয়। কিন্তু প্রত্যেকের শরীরে প্রথমেই উপসর্গ ফুটে ওঠেনি। ফলে প্রথমে ২০১১ সাল পর্যন্ত এবং তারপর ২০২০ সাল পর্যন্ত তহবিলের সময়কাল বাড়ানো হয়। তব গতবছর জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক ধাক্কায় এই সময়সীমা বাড়িয়ে দেন ২০৯২ সাল পর্যন্ত।
এর মধ্যেই ২০১১ সালে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর পাকিস্তানে তালিবান প্রধান ওসামা বিন-লাদেনকে এনকাউন্টারে হত্যা করে মার্কিন বাহিনী। ততদিনে অবশ্য আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে মার্কিন বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সমালোচনাও হয়েছে। যদিও ২০০৮ সালে বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অন্যতম বড়ো প্রতিশ্রুতি ছিল মধ্যপ্রাচ্য থেকে সেনা অপসারণ। যদিও প্রাথমিকভাবে আরও ১ লক্ষ সেনা পাঠান তিনি। কিন্তু লাদেনের মৃত্যুর পর সেই সমস্ত সেনাকেই সরিয়ে নেওয়া হয়। শুধু আরব সেনাবাহিনীর সহায়তার জন্য ৫০০০ জন থেকে যান।
আরও পড়ুন
এক মিনিটে ৫৬টি শব্দ উল্টোদিক থেকে পড়ে গিনেস বুকে নাম তুললেন আমেরিকার মহিলা
আজও অবশ্য বহু মানুষের শরীরে নতুন করে ফুটে ওঠে নানা রোগের উপসর্গ। ০৯/১১-র স্মৃতি আজও চরম বাস্তব। কিন্তু তার পরেও একথা বলতেই হয়, সেদিনের আক্রমণ শুধু কিছু অট্টালিকাই ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সেই সমস্ত অট্টালিকাই ২০১৮ সালের মধ্যে আবারও গড়ে তোলা হয়েছে। সেই ট্যুইন টাওয়ারের জায়গায় আছে আরও এক ট্যুইন টাওয়ার। কিন্তু আমেরিকার মেরুদণ্ড নাড়িয়ে দেওয়ার যে পরিকল্পনা নিয়েছিল তালিবানি বাহিনী, সেটা সফল হয়নি। সমস্ত দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে এক রূপকথার জন্ম দিয়েছে আমেরিকা।
Powered by Froala Editor