মধ্যপ্রদেশের চিরিমিরি প্রদেশ। বনজঙ্গল, পাহাড়ে ঘেরা কয়লাখনি অঞ্চল। চারিদিকে অদ্ভুত পাহাড়ি শোভা। তার মধ্যেই চলছে শুটিংয়ের কাজ। গোটা ক্রিউ টিমের সঙ্গে পাহাড়ের একটু উপরের দিকেই রয়েছেন মানিকবাবু, সত্যজিৎ রায়। তলা থেকে হাঁটতে হাঁটতে উঠে আসবে অপু আর পুলু। সিকোয়েন্সজুড়ে দুই চরিত্রের কথোপকথন। অপর্ণার মৃত্যুর পর বাড়ি ছেড়ে চলে আসা অপুকেই তার দায়-দায়িত্বের ব্যাপারেই বোঝাচ্ছে পুলু। অন্যদিকে টাকা পাঠানো ছাড়া আর কোনো কিছুতেই রাজি নয় অপু। কারণ, অপর্ণাই যে নেই আর।
শুটিংয়ের আগে বেশ কয়েকবার রিহার্সাল করে দেখে নিলেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু কোথায় যেন প্রাণবন্ত হচ্ছে না অভিনয়। চরিত্রের সহজাত ব্যাপারটাই ফুটে উঠছে না। সমাধানে এগিয়ে এলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। জানালেন, পাহাড়ি পথ ধরে উঠে আসার সময় খানিকটা হাঁপানির অভিনয় করতে হবে তাঁকে। তাতে কোলবেল্টের দুর্গমতাও যেমন ফুটে উঠবে, তেমনই স্পষ্ট হবে চরিত্রদের মধ্যে চলতে থাকে টেনশনের টানাপোড়েন।
কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এল না সেই ভাবটা। উপায়? নিজেই খুঁজে বার করলেন অভিনেতা। চড়াই পাহাড়ি রাস্তা ধরে তলা থেকে উপরের দিকে বেশ খানিকটা দৌড়ে উঠলেন তিনি। আর স্বাভাবিক নিয়মেই তারপর হাঁপ ধরে যাওয়া। তারপর ক্যামেরার সামনে অভিনয়, ডায়লগ। একবার নয়, বেশ কয়েকটি আলাদা আলাদা শটেই একইভাবে নিজেকে প্রস্তুত করলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। যেমনটা চেয়েছিলেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়, ক্যামেরায় ধরা পড়ল তেমনটাই।
শীতকাল একটু জাঁকিয়েই পড়ে এই কোলবেল্ট অঞ্চলে। আর শীতের মুখেই হয়েছে সেই শুটিং। রাতের বেলায় টের পেলেন তিনি। দীর্ঘস্থায়ী হয়ে গেছে সেই শ্বাসকষ্ট। রাত যত বাড়ল ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ল অসুস্থতা। অথচ সামান্যতম বিচলিত নন তিনি। কারণ, নিজের অভিপ্রেত অভিনেতা সত্তাটাকেই যে নিঙড়ে বের করে নেওয়া গেছে। পরিচালকের মানসচক্ষে দেখা সিকোয়েন্স ফুটিয়ে তোলা গেছে বাস্তবিকভাবে। নিজের কাছেই এ যেন এক চ্যালেঞ্জ-জয়।
নিজের অভিনয়ের কর্মক্ষমতাকে এভাবেই বার বার পরীক্ষা করতে দেখতে চাইতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। চরিত্রদের গঠন করতে চাইতেন নির্মেদভাবে। তার জন্য নিজত্বটাকেও অভিনয়ের সূত্রে পরিবর্তন করতে পিছপা হননি কিংবদন্তি অভিনেতা।
১৯৬৪ সাল। বছর পাঁচেক সময় পেরিয়ে গেছে ‘অপুর সংসার’-এর। ‘চারুলতা’র জন্যও সত্যজিৎ রায় তুলে আনলেন তাঁর আবিষ্কৃত তুরুপের তাস সৌমিত্রকেই। সেই সিনেমাতেই রয়েছে হাতের লেখার ছোট্ট একটি সিন। চরিত্রের প্রয়োজনেই হাতের লেখা বদলের দায় এড়াতে পারলেন না কিংবদন্তি। রবীন্দ্রনাথের সময়ে যে ধরণের হাতের লেখার চল ছিল, তেমনটাই করায়ত্ত করতে হবে তাঁকে। শুধু শুটিংয়ের সময়ই না, বাড়িতেও চলল তার অক্লান্ত অনুশীলন। বাড়িতে অবসর সময়ে ক্রমাগতই তিনি লিখে চলেছেন সাদা খাতায়। মনে যা আসছে তেমনটাই লিখে ফেলছেন পরীক্ষামূলক বিভিন্ন হস্তাক্ষরে। অবশেষে যখন খুঁজে পাওয়া গেল অভীষ্ট হস্তাক্ষর, তারপর আরও অসংখ্যবার তার অনুশীলন। ভরে উঠল গোটা খাতা। নিজেও টের পেলেন এই হাতের লেখাই যেন নিজস্ব হাতের লেখাকে প্রতিস্থাপন করে ফেলেছে অজান্তেই।
আরও পড়ুন
ছুটির দিনে কফি হাউসে বসেই পত্রিকা সম্পাদনা করতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
অভিনয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল একদম ছোটো বয়স থেকেই। তবে তা ক্যামেরার সামনে নয়। মঞ্চে। বাড়িতে নাট্যচর্চা, কবিতা, আবৃত্তির পরিবেশ ছিলই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাবা নিজেও ছিলেন একজন নাট্য অভিনেতা। কাজেই বাড়িতে উৎসাহের অভাব ছিল না। তক্তপোষকে মঞ্চ বানিয়েই চলত অভিনয়। বিছানার চাদর বদলে যেত পর্দায়।
ছোটোবেলার সেই অভিজ্ঞতাই রুপোলি পর্দায় অভিনয় করতে সাহায্য করেছিল বহুলাংশে। তবে সবটা তো এক নয়। আত্মবিশ্বাসটা ছিলই। বাকি সমস্ত কিছুই হাতে ধরে শিখিয়ে দিলেন প্রথম পরিচালক সত্যজিৎ রায়ই। নতুন করে যেন তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন সৌমিত্রের অভিনেতা সত্তাকে। বয়সে বড়ো হয়েও নিকটতম বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন ‘মানিকদা’। ছিলেন শিক্ষকও।
কোন সিকোয়েন্সে ঠিক কীভাবে অভিনয় করলে চরিত্রের চরিতার্থ করা যাবে, প্রকৃতভাবে সেটাই বুঝতে শিখিয়েছিলেন সত্যজিৎ। ‘অপুর সংসার’-এই একটি দৃশ্য ছিল অপু আর পুলুর থিয়েটার দেখে ফেরার। অভিনয়ে খামতি ছিল না কোনো সেই দৃশ্যের শুটিং। তবে দেখা দিল অন্য একটা সমস্যা। শুটিং শেষে দেখা গেল ট্রলি ক্যামেরা থেকে ঠিকঠাক আসেনি ক্লোজ শট। অগত্যা সত্যজিৎ ঠিক করলেই স্টুডিয়োতেই নেবেন সেই শট। হলও তাই। অন্ধকারে শুধু আলো পড়ল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মুখে। টেক নিল ক্যামেরা।
আরও পড়ুন
হিন্দি ও ফরাসি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন সৌমিত্র, হাত পাকিয়েছেন পরিচালনায়
কিন্তু সামনে কোনো অভিনেতা নেই। কাকে উদ্দেশ্য করে বলবেন সেই সংলাপ? কীভাবেই বা আসবে সেই অনুভূতি? ফ্লোরে হাঁটতে নির্দেশ দিলেন সত্যজিৎ। পুশট্রলি থাকল পাশে পাশে। তবে সেখানে ক্যামেরার বদলে থাকলেন স্বয়ং পরিচালক।
অভিনয়ের ক্ষেত্রে ‘মানিকদা’ এভাবে অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন তাঁর, বারবার সেই কথাই তুলে এনেছিলেন সত্যজিৎ। ১৯৫৯ সালে ‘অপুর সংসার’-এর অভিনয় দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন আরেক বাঙালি কিংবদন্তি পরিচালক তপন সিংহ। নিজের চলচ্চিত্রের জন্যই একরকম নির্ধারিত করে ফেলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম। ফোন গেল তাঁর কাছে। গেল প্রস্তাবও। তবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া খানিকটা অপ্রত্যাশিতই ছিল তাঁর কাছে। কোনো নিশ্চয়তাই দিলেন না তিনি। বরং সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য সময় চেয়ে নিলেন খানিকটা।
তখনও পর্যন্ত সিনেমার পর্দায় অভিনয় মানে একটাই মাত্র সিনেমা। ‘অপুর সংসার’। তরুণ এমন একজন অভিনেতার এই সুযোগ থেকেও মুখ সরিয়ে নিচ্ছে নির্লিপ্তভাবে? তবে এই সময় চাওয়ার কারণটা ছিল অন্য। আসলে ‘গুরু’-র থেকেই পরামর্শ নিতে চাইছিলেন সৌমিত্র। এই সিনেমায় অভিনয় করা তাঁর উচিত কিনা জানতে দ্বারস্থ হয়েছিলেন সত্যজিতের কাছে। বলাই বাহুল্য, এই সিনেমায় অভিনয় করতে বাড়তি উদ্যোম জুগিয়েছিলেন তিনিই।
আরও পড়ুন
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র
‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর জন্য শিখলেন হাসার রকমফের। রপ্ত করলেন অশ্বারোহণও। পরবর্তীকালে ‘ঝিন্দের বন্দী’ সিনেমায় আরও একবার কাজে লাগল অশ্বারোহণের দক্ষতা। তবে অনুশীলনের মাধ্যমে বাড়াতে হয়েছিল পটুত্বকে। আয়ত্ত করতে হয়েছিল অশিচালনাও। সেই শিক্ষানবিস মনোভাবই অপরিবর্তিত ছিল তাঁর অভিনয়জীবন জুড়ে। যেন সহজাত হয়ে গিয়েছিল ছক ভাঙার সেই খেলা। অভ্যেসে পরিণত হয়েছিল শেখার খিদে।
বয়স বাড়লেও সম্পৃক্ত হয়নি সেই জায়গাটাই। শিক্ষানবিশ থেকে হয়েছিলেন অভিভাবক। তাও নিজেকে পরীক্ষা করে দেখার প্রবণতায় খামতি হয়নি কখনোই। তাই জন্যই শেষ বয়সে এসেই নিজের লেখায় ফিরে দেখার কথাই লিখে গেলেন কিংবদন্তি অভিনেতা। এতকাল ধরে ঠিক কী করে এসেছেন তিনি। অভিনয়জীবনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ঠিক কোন বিন্দুতে...
তথ্যসূত্র-
১. চরিত্রের সন্ধানে – সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
২. মানিকদার সঙ্গে – সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor