কর্পোরেট বোর্ডরুম থেকে শুরু করে তাবড় শিল্পপতি— সকলের চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনাকে নাড়িয়ে দিয়েছে করোনা মহামারি। আর আমাদেরও নতুন করে ভাবতে হচ্ছে ভবিষ্যৎ কাজের পরিধি নিয়ে। প্রায় সকলেরই ধারণা, সহনশীলতা, ধৈর্য এবং দক্ষতা ইত্যাদি গুণগুলিই ভবিষ্যৎ নির্ধারণের মাপকাঠি হতে চলেছে। এবং সেই অনুযায়ী বদলানোর দরকার পড়েছে কাজের পরিবেশকেও। কিন্তু এগুলো তো রাতারাতি চলে আসার নয়। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, তাহলে কেন এই বিষয়গুলি নিয়ে ভাবা হল না এতদিন?
১৮-শ শতকে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব গোটা পৃথিবীর ছবিটাই বদলে দিল। কাজের জায়গা থেকে শুরু করে মানুষের জীবন— সমস্ত জায়গাতেই একটা গভীর প্রভাব পড়ল। যত বেশি সম্ভব জিনিস তৈরি করে যাও, শ্রম দিয়ে যাও, তাহলেই কাজের কাজ হবে। এটা একটা নিয়মের মধ্যে মানুষকে বেঁধে রাখলেও, দিনের শেষে যান্ত্রিক কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। সেখানে কর্মীদের মধ্যে সৃজনশীলতার জায়গা কমে গেল, নতুন কিছু ভাবনার জায়গাটা চলে গেল। কোম্পানির সুপারভাইজার তোমাকে নির্দেশ দেবে, আর বিনা বাক্যব্যয়ে যন্ত্রের মতো সেই কাজটি করতে হবে। এমনটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়াল…
কিন্তু যত সময় এগোতে শুরু করল, ততই পরিস্থিতি বদলাতে থাকল। কাজ আর স্রেফ ‘জো-হুজুর’ বলার জিনিস থাকল না; সেখানে উঠে এল স্কিল বা দক্ষতা। যে একটা স্টিম ইঞ্জিন তৈরি করছে, তার দক্ষতা তো একজন মুচির মতো হবে না। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জায়গা, কাজের ধরণ আলাদা; স্টিম ইঞ্জিন তৈরি করা তুলনায় কঠিন কাজ। তার থেকেও কঠিন কাজ রকেট তৈরি করা। আর এখানেই প্রয়োজন হল স্কিলের। ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন নতুন কাজের জায়গা তৈরি হলেও, সেটা যে খুব বেশি তা কিন্তু নয়। বদল আসা এখনও বেশ কিছুটা বাকি ছিল…
সাম্প্রতিক সময় এসে যেন আরও একটা শিল্পবিপ্লব তৈরি হল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, ততই বাড়ছে কাজের পরিধি। আর সেজন্য নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। আগে যে কাজ মানুষে করত, এখন হয়তো সেটা রোবটের মাধ্যমেই হয়ে যাচ্ছে। ফলে নতুন নতুন ভাবনার জায়গা খুলে যাচ্ছে। চাকরির বাজার বাড়ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে দক্ষতার চাহিদাও। তবে তোমাকে স্রেফ টেক-স্যাভি হলেই চলবে না, চাকরির জন্য নিজেকে তৈরিও করতে হবে। শুধু টেকনিকাল স্কিল নয়, আরও আরও অনেক কিছু। আর এই মুহূর্তে করোনা অতিমারি আরও একটা বদল আনতে চলেছে।
আর এর জন্য এখন এমন কাজ তৈরি হবে যেখানে একটা টিমের সৃজনশীলতা, চিন্তা-ভাবনা আর দক্ষতার ছাপ থাকবে। সেটা অটোমেশনে সম্ভব নয়। কিন্তু এখনও অনেক কোম্পানি এই জায়গায় আসতে চাইছে না। সেটা কেন? তিন ধাপে এর উত্তর দেওয়া যায়…
প্রথমত এর জন্য দরকার আচরণগত মূল্যায়ন এবং প্রশিক্ষণ। প্রযুক্তি বা কাজের দিক থেকে কী কী খামতি তা সহজেই ধরা যায় এবং সেইমতো প্রশিক্ষণও দেওয়া যায়। কিন্তু একজনের মাইন্ডসেট, কাজের জায়গায় আচরণের জায়গার খামতিগুলো ধরা ও বোঝা খুব মুশকিল। এর জন্য বাজারে বেশ কিছু নির্ভরযোগ্য সাইকোমেট্রিক স্কেল আছে বটে; কিন্তু সেসবের জন্য অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন। এতকিছু মেনে একটা ট্রেনিং রুটিন তৈরি করাও সহজ কাজ নয়। এখনও অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে, অনেক কোম্পানি নিজেদের মতো করে কাজ করছে। কিন্তু এটা একটা সমস্যার জায়গা।
আরও পড়ুন
ছড়াতে পারে নিপা-সহ একাধিক নোভেল ভাইরাস! আশঙ্কা নতুন মহামারীর
দ্বিতীয়ত, মানবকেন্দ্রিক কাজ বললেই আমরা অন্যরকম কিছু ভাবি। এইচআর বা চেঞ্জ ম্যানেজমেন্টের মতো। একবিংশ শতাব্দীর দুটো দশক পেরিয়ে গেছে; অথচ আমাদের চিন্তাধারা সেই পুরনো আমলেই পড়ে আছে। একটা কোম্পানি যদি একটা জটিল যন্ত্র হয়, তার কর্মীরা হল চালিকাশক্তি। আমার কাছে যদি পর্যাপ্ত তথ্য এবং তার বিশ্লেষণ থাকে, তাহলে সেসব দেখে আমরা বুঝতে পারব একজনের মধ্যে আদৌ কতটা বদল এসেছে। কিন্তু যারা এই সিস্টেমের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাঁদের কথা এখানে খুব কমই আসে।
এবং তৃতীয়ত, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। নব্বইয়ের দশকে আমেরিকায় শিক্ষার একটি নতুন সিস্টেম চালু হল। নাম স্টেম; যার মধ্যে মূলত ছিল সায়েন্স বা বিজ্ঞান, টেকনোলজি বা প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং আর অঙ্ক। এর মূল লক্ষ্যই ছিল ছাত্রছাত্রীদের টেকনিকাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং দিক থেকে শিক্ষিত করা। এবং এই বিষয়টাকেই লক্ষ্য করে এগিয়ে গেছে সবাই। এখানেই শুরু হল মূল সমস্যা। কর্মীদের আসল গুণ, প্রতিভাগুলি এখানে চাপা পড়ে যায়; আর ঠিক এই জিনিসগুলোই এখন দরকার। এমনকি আজকের দিনে দাঁড়িয়েও তথাকথিত ‘হার্ড স্কিল’-এর দিকেই বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে। একটা সময় স্টেম মডেল নিঃসন্দেহে সফল ছিল; কিন্তু আজ আর নয়। এরকমও মানুষেরা আছেন, যারা অত্যন্ত উঁচু পদে কাজ করেন, কিন্তু তাঁদের মাইন্ডসেট বা ব্যবহারের জায়গাটা একেবারেই ঠিক নয়।
একটা স্মার্ট, ঝকঝকে কাজ তৈরি করলাম, দেখলাম আর সেই ফ্রেমওয়ার্কেই সমস্তটা সম্পন্ন হল— বিষয়টা এতটাও সহজ নয়। মানুষের আসল চাহিদাকে বুঝতে হবে, কর্মীদের মানসিক পরিস্থিতি বুঝতে হবে; এবং ‘কর্মীরাই প্রথম এবং প্রধান’ এটা জোর গলায় বলতে হবে। এবং এই পুরো বিষয়টা দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে করতে হবে, কখনই বাধ্য হয়ে নয়।
আরও পড়ুন
করোনার পর ব্রুসেলোসিস, নয়া মহামারীতে আক্রান্ত চিনের ৬ হাজার মানুষ
Powered by Froala Editor