প্রতিবেশীদের বাধা, সাংসারিক দ্বন্দ্ব পেরিয়েও বছরভর লড়াই; কোভিড-যোদ্ধা নার্সদের গল্প

“অতিমারী তো এসে পড়ল হঠাৎ করেই। আমরা বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু তার মধ্যেই সবাই মিলে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তা সত্যিই অবাক করার মতো।” বলছিলেন ডোমজুড় ব্লকের পাবলিক হেলথ অফিসার স্বাগতা সিংহ রায়। আন্তর্জাতিক নার্স দিবসের আগে ভাগ করে নিলেন তাঁর অভিজ্ঞতা। স্বাগতা জানালেন, “লকডাউন ঘোষণা করে দেওয়া হল রাতারাতি। কিন্তু নার্সদের তো হাসপাতালে পৌঁছতে হবে। কলকাতায় তবু দিনে একটা দুটো বাস চালু হয়েছিল স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য। গ্রামেগঞ্জে সেটুকু বন্দোবস্তও ছিল না। কোনো কোনো নার্স হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন পায়ে টানা খোলা ভ্যানে।” অতিমারীর এক বছর পেরিয়ে এসেও সেই লড়াই থামেনি।

লড়াই তো শুধু হাসপাতালে নয়। ঘরে এবং প্রতিবেশীদের মধ্যেও সমানে চলেছে যুদ্ধ। এসএসকেএম হাসপাতালের নার্স দিশা ঘোষ বলছিলেন, “প্রথম যখন সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, সবাই আমাদেরই সন্দেহ করত। যেন আমরাই ভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছি। বহু জায়গায় নার্সদের পাড়ায় ঢুকতে দিতে চাইছিলেন না প্রতিবেশীরা।” এসএসকেএম হাসপাতালের আরেক নার্স স্বর্ণালী নস্কর বলছিলেন, “বহু নার্স ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। লকডাউনের সময় বাড়িওয়ালা জানিয়ে দেয়, হয় বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে নয়তো হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ করতে হবে।” এমনকি তাঁর পরিচিত এক সহকর্মীকে নিজের স্বামীই ঘরে ঢুকতে দেননি বলে জানালেন স্বর্ণালী। তবে তাঁরা বলছিলেন পরিস্থিতি এখন অনেকটা বদলেছে।

দিশার কথায়, “আসলে দ্বিতীয় তরঙ্গের সংক্রমণ এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে করোনা এখন মানুষের ঘরে ঘরে। তাই আমাদের আক্রমণ না করে তাঁরা ভাবছেন যদি আমাদের থেকে সাহায্য পাওয়া যায়। হাসপাতালের শয্যা বা প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র পেতে যদি আমরা সাহায্য করতে পারি।” তবে নিজেদের মনের মধ্যেও তো আশঙ্কা থেকে যায়। স্বর্ণালী বলছিলেন, “আমরা হাসপাতাল থেকে ফিরে সন্তানের কাছে ছুটে যেতে পারি না। পরিবারের সদস্যদের থেকেও দূরে দূরে থাকতে হয়। যদি আমাদের জন্যই তাঁরা আক্রান্ত হন?” স্বাগতা সিংহ রায় জানালেন তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা। “লকডাউনের কিছুদিন আগেই বাবা মারা গিয়েছেন। মা ক্যানসারে আক্রান্ত। মায়ের কাছেও যেতে পারিনি দীর্ঘদিন। এমনিতেই তো সাত দিনের একটানা ডিউটি। তারপরেও বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে যেতে পারতাম না। সেটাও একটা লড়াই।” আর তাছাড়া সবসময় পিপিই কিট পরে থাকার যন্ত্রণা তো রয়েছেই। দিশা বলছিলেন, “একটা কিট পরতেই সময় লাগে ৭-৮ মিনিট। আর কিছুক্ষণ পরে থাকলেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। এই গরমের মধ্যে পিপিই কিট পরে থাকার কষ্ট আরও বেশি। কিন্তু এটুকু তো সহ্য করতেই হবে।”

আর এইসমস্ত লড়াইয়ের সঙ্গে বর্তমানে নতুন নতুন সমস্যাও তৈরি হয়ে চলেছে। কোথাও হাসপাতালে শয্যা নেই, কোথাও অক্সিজেন বা ওষুধের সরবরাহ নেই। ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়াও একরকম স্তব্ধ। তবু এসবের মধ্যেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন দেশের সমস্ত নার্স। কখনও প্রিয়জন হারানোর আশঙ্কায় বা দুঃখে রোগীর আত্মীয়রা রুষ্ট হচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীদের উপরেই। স্বর্ণালী বলছিলেন, “এটা তো স্বাভাবিক। আমরাও কি প্রিয়জনদের হারানোর যন্ত্রণার সময় সমস্তকিছু যুক্তি দিয়ে ভাবতে পারব? কাউকে না কাউকে দোষী মনে হবে তখন। আর আমরাই সেখানে সামনে থাকি।” তবে স্বাগতা জানালেন এই ধরণের অভিযোগ আগের চেয়ে অনেক কম। তিনি বলছিলেন, “মহামারীর আগে তো নানা সময় হাসপাতাল ভাংচুর বা নার্স ও চিকিৎসকদের আক্রমণ করার ঘটনা শোনা যেত। এখনও অবধি আমি তেমন কোনো অভিযোগ শুনিনি। সামান্য মৌখিক অপমান সহ্য করতে হয় অবশ্য মাঝে মাঝে।” 

আরও পড়ুন
প্রয়াত নেতাজির সহযোদ্ধা লালতি রাম, করোনা কেড়ে নিল আইএনএ সেনাধ্যক্ষকেও

পাশাপাশি অবশ্য সম্মানেও কমতি নেই। স্বাগতার কথায়, “হাসপাতাল যাওয়ার জন্য টোটো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি, চালকরা নিজেরা এগিয়ে এসে বলেন ‘ম্যাডাম আগে আপনি বসুন। আপনার হাসপাতালে তাড়াতাড়ি পৌঁছনো দরকার।’ এও কি কম প্রাপ্তি?” 

আরও পড়ুন
সীমান্ত ছেড়ে, করোনা মোকাবিলায় এবার সামিল সামরিক চিকিৎসকরাও

না, প্রাপ্তির ঝুলি শূন্য নয়। আর এই ভালোবাসাকে পাথেয় করেই লড়ে যাচ্ছেন তাঁরা। সুস্থ করে তুলছেন হাজার-হাজার কোভিড-আক্রান্তকে। আন্তর্জাতিক নার্স দিবসে, প্রহরের পক্ষ থেকে তাঁদের স্যালুট...

আরও পড়ুন
রক্তনালিতে 'বিষ' ছড়ায় করোনার স্পাইক প্রোটিন!

Powered by Froala Editor

More From Author See More