প্রথম পর্ব
ভারতের স্বাধীনতার পাশাপাশি যে ঘটনা সমানভাবে উঠে আসে, তা হল দেশভাগ। ১৯৪৭-এর সেই বিভাজনের ক্ষত এখনও সেরে ওঠেনি পুরোপুরি। ব্রিটিশ সরকার, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ – প্রত্যেকের মদতেই যে সংগঠিত হয়েছিল এই ট্র্যাজেডি – তা নিয়ে আজ আর দ্বিমত নেই। তবে, সে-সময়কার আরেকটি অধ্যায় নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয় না। তা হল, বাংলা ভাগ আটকানোর উদ্যোগ। হ্যাঁ, কয়েকজন বাঙালি নেতা প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন বাংলাকে অক্ষুণ্ণ রাখার। চেয়েছিলেন, স্বাধীন ও অখণ্ড একটি দেশ হোক বাংলা।
দ্বিতীয় পর্ব
অখণ্ড থাকুক বাংলা, চাননি নেহরু-প্যাটেল-শ্যামাপ্রসাদ
১৯৪৭-এর শুরুর দিক। তখন চারপাশে ভারতের স্বাধীনতার গুঞ্জন উঠতে শুরু করেছে। এও শোনা যাচ্ছে, ভারতকে স্বাধীনতা দিতে গেলে পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশকে ভাগ করতেই হবে। এমন পরিস্থিতিতে, বিকল্প এক প্রস্তাব নিয়ে আসেন তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন সোহরাওয়ার্দী। ২৬ এপ্রিল ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে তিনি বলেন, বাংলা ভাগ না করে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। মাউন্টব্যাটেন কিন্তু সোহরাওয়ার্দীকে নিরাশ করেননি। তিনি বলেছিলেন, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ যদি মেনে নেয়, অখণ্ড বাংলার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের কোনো আপত্তি থাকবে না।
‘এটি ভুলবেন না যে আমার প্ল্যানে পাকিস্তান বা হিন্দুস্তানের অংশ নয় এমন একটি যুক্ত অথচ স্বাধীন বাংলার পথ খোলা রয়েছে।’
ওদিন অর্থাৎ ২৬ এপ্রিলই মাউন্টব্যাটেন একটি বৈঠক করেন মহম্মদ আলী জিন্না-র সঙ্গে। জিন্না জানান, অবিভক্ত ও স্বাধীন বাংলার প্রস্তাবে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। বলেন – ‘আমি আনন্দিত হব। কলকাতা ছাড়া বাংলার কী মর্যাদা রয়েছে? ওদের(বাঙালিদের) পক্ষে যুক্ত ও স্বাধীন থাকাই ভালো হবে।’
পরদিন, দিল্লিতে একটি প্রেস কনফারেন্সে সোহরাওয়ার্দী বলেন, যদি বাংলা অবিভক্ত থাকে, তাহলে এটি একটি অসামান্য রাষ্ট্র হবে। এবং সেই দেশটি স্বাবলম্বীও হবে সবদিক দিয়ে। তিনি বলেন –
Let us pause for a moment to consider what Bengal can be if it remains united. It will be a great country, indeed the richest and the most prosperous in India capable of giving to its people a high standard of living, where a great people will be able to rise to the fullest height of their stature, a land that will truly be plentiful. It will be rich in agriculture, rich in industry and commerce and in course of time it will be one of the powerful and progressive states of the world. If Bengal remains united this will be no dream, no fantasy.
১৮ এপ্রিল মাউন্টব্যাটেন বাংলার গভর্নর ফ্রেডরিক বারোজকে টেলিগ্রামে জানান – ‘এটি ভুলবেন না যে আমার প্ল্যানে পাকিস্তান বা হিন্দুস্তানের অংশ নয় এমন একটি যুক্ত অথচ স্বাধীন বাংলার পথ খোলা রয়েছে।’
এদিকে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দাদা শরৎচন্দ্র বসুও চাইছিলেন বাংলা বিভাগ রুখতে। তিনি প্রস্তাব এনেছিলেন ভারতের মধ্যেই বাংলা হোক একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। এ-নিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সামান্য মতপার্থক্য থাকলেও, বাংলা-বিভাগ রুখতেই হবে – এটাই ছিল তাঁদের মূল লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যে, ২০ মে শরৎচন্দ্র বসুর বাড়িতে একটি বৈঠক হয়। উপস্থিত ছিলেন হোসেন সোহরাওয়ার্দী, শরৎচন্দ্র বসু, মুহম্মদ আলী, ফজলুর রহমান, কিরণশঙ্কর রায়, আবুল হাশিম, আব্দুল মালেক এবং সত্যরঞ্জন বক্সী।
এই বৈঠকে নেতাদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়, যে-চুক্তির মধ্যে ছিল বাংলা-সংক্রান্ত পরিকল্পনা ও কর্মসূচি। যেমন, বাংলা হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র, ব্রিটিশ সরকার স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব মেনে নিলে বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হবে ও নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে, প্রধানমন্ত্রী বাদে সমানসংখ্যক হিন্দু-মুসলমান থাকবেন নতুন মন্ত্রিসভায়, সব চাকরিতে হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যা সমান থাকবে এবং এসব চাকরিতে শুধুমাত্র বাঙালিদেরই নিয়োগ করা হবে – ইত্যাদি। আর, স্বাধীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন মুসলিম ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন একজন হিন্দু। সমগ্র পরিকল্পনাটি পরিচিত হয় ‘বসু-সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাব’ নামে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
দ্বিতীয় পর্ব
অখণ্ড থাকুক বাংলা, চাননি নেহরু-প্যাটেল-শ্যামাপ্রসাদ