সালটা ১৯৬৩। বাংলার রুপোলি পর্দা আবারও তার প্রিয় মহানায়কের অপেক্ষা করছিল। উত্তমকুমার মানেই ক্যারিশমা, সেই ভুবনভোলানো হাসি, সেই প্রেমিক রূপ। এবার নাকি তিনি গায়কের ভূমিকায়। সঙ্গীতের দায়িত্বে স্বয়ং শ্যামল মিত্র; ছবির প্রযোজকও তিনি। প্রশান্ত কুমার রায় ওরফে অভিজিৎ চৌধুরী ওরফে ‘হৃদয় হরণ’-এর গলা বেজে উঠবে তাঁরই সুরে। আর বিপরীতে? এখানেই চমক লাগল দর্শকের। ‘সুচরিতা’র চরিত্রে যিনি অভিনয় করবেন, তিনি নাকি বাঙালি নন! উত্তমের বিপরীতে অভিনয় করবেন, অথচ বাংলাটাই বলতে পারবেন না! কিন্তু পর্দায় চোখ রাখতেই বাঙালি অবাক। শুনে তো মনে হচ্ছে না ইনি অবাঙালি! তাহলে বোধহয় ডাবিং করিয়েছেন। খবর হল, কাউকে দিয়ে নয়; নিজেই নিজের ডাবিং করেছেন তনুজা সামারথ। ব্যস, আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বলিউড তো বটেই, বাংলার আপামর দর্শকের কাছে তিনি হয়ে গেলেন ‘তনুজা’…
আজ অবশ্য তাঁর আলাদা করে পরিচয় দেওয়ার কোনো দরকার নেই। হোক না মুম্বাইতে জন্ম, হোক না মারাঠি, সেসবের প্রয়োজন নেই। তনুজা যে বাঙালিই! নিজের প্রথম বাংলা ছবি ‘দেয়া নেয়া’-তেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, থাকতেই এসেছেন। এরপর আরও বহু সিনেমা করবেন তিনি, বাংলা আর হিন্দি সিনে জগতের গণ্ডি ছাড়িয়ে নিজেকে ছড়িয়ে দেবেন আরও অনেক জায়গায়। দেখতে দেখতে কবে যে ‘সামারথ’ পদবিটি মুছে গেল, নিজেও টের পেলেন না তনুজা। বাঙালি পরিচালক সমু মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী, অভিনেত্রী কাজল-তানিশার মা— এসবের আগেও তাঁর পরিচয়, তিনি তনুজা! ভারতীয় সিনেমার অন্যতম উজ্জ্বল একটি নাম।
সিনেমা তাঁর রক্তে ছিল। দিদিমা রত্তন বাই ছিলেন নির্বাক যুগের অভিনেত্রী। মা শোভনা সামারথ ছিলেন চল্লিশের দশকের অন্যতম অভিনেত্রী। বাবা কুমারসেন সামারথও ছিলেন পরিচালক। এই ধারারই পরবর্তী বাহক হলেন তনুজা। অবশ্য তিনি একা নন; বড়ো দিদি নূতনও ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে জায়গা পেয়েছেন। দিদির সঙ্গেই ১৯৫০ সালে প্রথমবার ছবি করেন, নাম ‘হামারি বেটি’। তনুজা তখন ‘বেবি তনুজা’; বয়স মাত্র সাত। তার দশ বছর পরেই বলিউডে প্রকৃত অভিষেক হল তাঁর। ১৯৬০ সালে মা শোভনা সামারথের পরিচালনায় ‘ছাবলি’ সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। এবারও সঙ্গী দিদি নূতন…
এমন সময়ই তাঁর প্রবেশ বাংলা সিনেমার জগতে। তার আগে তনুজা অভিনীত ‘হামারি ইয়াদ আয়েগি’ বেশ প্রশংসিত হয়। পরিচালক-সমঝদারদের নজরে আসেন তিনি। আর সেই সময়ই অবতারণা ‘দেয়া নেয়া’-র। বাকিটা, ইতিহাস। উত্তমের বিপরীতে তনুজার অভিনয়ও নজর কাড়ে সকলের। উত্তম-পর্ব অবশ্য এখানেই শেষ হয় না। ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’-কে কি ভোলা যায়? বা ‘রাজকুমারী’? প্রতিটা জায়গায় নিজের ছাপ রেখে গেছেন তিনি।
তবে তনুজা’র নাম এলে উল্টোদিকে আরেকজনের নাম তো আসবেই। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ‘তিন ভুবনের পারে’-র সেই টুইস্ট, সঙ্গে সেই এভারগ্রিন গান। সামনে সৌমিত্র, মুখে একটাই কথা, ‘কে তুমি নন্দিনী’? তনুজাও ধীরে ধীরে সেই স্বপ্নের ‘নন্দিনী’ হয়ে উঠলেন। ‘প্রথম কদম ফুল’-এও ফিরে এলেন দুজনে। আবারও নিয়ে এলেন অপূর্ব সব গান। ‘শহর থেকে আরও অনেক দূরে’ যাওয়ার মন্ত্র শোনালেন মান্না দে। সব মিলিয়ে স্বর্ণযুগের সারণিতে তৈরি হল আরও কিছু দৃশ্য।
শুধু কি বাংলা সিনেমা? ‘জুয়েল থিফ’, ‘বাহারে ফির ভি আয়েঙ্গি’, ‘অনুভব’, ‘হাথি মেরে সাথী’, ‘মেরে জীবন সাথী’— তালিকাটা অনেক বড়ো। দেব আনন্দ, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চনের নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছেন। কিন্তু নিজের জায়গাটুকু ধরে রেখেছেন প্রবলভাবে। লক্ষ্য ছিল একটাই, রূপে নয়, নায়িকা হিসেবেও নয়; বরং একজন ভালো অভিনেত্রী হিসেবে জায়গা পেতে চান। অভিনয়টা ভালো করে করতে চান। সেই জায়গায় কোনোদিনও ফাঁকি দেননি তনুজা। সমু মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেছেন; একটা সময় দুজনে আলাদাও থেকেছেন। কিন্তু জীবনের কাছে হার মানেননি তনুজা। নতুন কিছু শেখার ইচ্ছা তাঁর যে ছিল প্রবল। জীবনের কাছে তিনি আজীবন একজন ছাত্রী হয়েই থেকেছেন। বাঙালি পরিবারে জন্মাননি, আশেপাশে সেরকম পরিবেশও পাননি; সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গা থেকে এসে বাংলা ভাষাটাকে ভালোবেসেছিলেন। নিজেই শিখেছিলেন, এমনকি ডাবিংও নিজেই করতেন। নতুন নতুন ভাষা শিখতে কখনও ক্লান্তি নেই তাঁর।
আরও পড়ুন
সুপ্রিয়ার সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ দিতে হবে; ঋত্বিক ঘটককে শর্ত দিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
আর আছে অভিনয়। মেয়ে কাজল বলিউডের অন্যতম নামী অভিনেত্রী। কিন্তু সেই পরিচয়ে ঢাকা পড়ে যায়নি তনুজার নিজস্ব শৈলী। সেই সিনেমাই তাঁকে এনে দিয়েছে ‘ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’ সম্মান। যেখানে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন, সবটুকু দিয়ে দিয়েছেন। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ দেখা গেছে ‘সোনার পাহাড়’-এ। ২০১৮ সালে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত এই ছবির হাত ধরেই বাংলা সিনেমার জগত ফিরে পেয়েছিল তার ‘নন্দিনী’-কে। এখনও সেই ঝলক, সেই ব্যক্তিত্ব, তেমনই অভিনয়। সঙ্গে আবারও মুখোমুখি সৌমিত্র-তনুজা। যিনি আজও ভালোবাসেন নিজের লাইব্রেরি ঘরটিকে। এত বর্ণময় জীবন, কখনও ইচ্ছা করে না নিজের জীবনী লিখতে? একটু হাসেন ‘নন্দিনী’। কিংবা হয়তো বিরক্তও হন। এত ইন্টারভিউ দিয়েছেন, আবার আত্মজীবনীর কি প্রয়োজন? জীবনকে লেখা অত সহজ নাকি! সেই জীবনের সাঁকোয় দাঁড়িয়ে তনুজা আজও কিংবদন্তি, আজও অমলিন তাঁর হাসিটি।
তথ্যসূত্র-
১) ‘Remembering Uttam Kumar: Did You Know These Almost Forgotten Facts About The Acting Legend?’, The Times of India
আরও পড়ুন
ত্রুফো-র দুই চরিত্র অভিনয় করেছিল টারান্টিনো-র ছবিতে
২) ‘বাস্তবের বন্ধুত্বই বড়ো পর্দায়’, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘মা সিঙ্গল পেরেন্ট, নিজেও প্রায় একাই মেয়েদের বড় করেছেন বলি-টলি কাঁপানো এই অভিনেত্রী’, আনন্দবাজার পত্রিকা
৪) ‘তনুজা হওয়ার ছোট্ট গল্প’, আবু সঈদ, প্রথম আলো
আরও পড়ুন
৩৬০টি সিনেমায় অভিনয়, কমেডিয়ানের ‘অভিশাপে’র মধ্যেও জাত চিনিয়েছেন অনুপকুমার
৫) উইকিপিডিয়া
Powered by Froala Editor