চুল্লির মধ্যে আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছে ভাইয়ের দেহ। দেখছেন তিনি। দেখছেন, কীভাবে আগুন এসে ঘিরে ধরছে ভাইকে। আস্তে আস্তে নেমে এল ফার্নেসের শাটার। শেষ সে-দেখায়, ভাইয়ের পা-দুটি দেখতে পেলেন তিনি। কালো, রোগা, শুকিয়ে যাওয়া দুটো পা। আস্তে আস্তে আগুন গিলে নিচ্ছে সব। অথচ এই পা একদিন ছিল ফর্সা, গোলগাল। পাঁচ বছর বয়সে চৌবাচ্চায় ডুবতে-বসা ভাইকে এই পা ধরেই টেনে তুলেছিলেন তিনি। বাঁচিয়েছিলেন ভাইকে। অথচ আজ, একেবারে চলে যেতে দেখেও কিছু করতে পারছেন না। তাকিয়ে আছেন শূন্য দৃষ্টিতে। ভাবছেন – এবারও যদি ওই পা ধরেই টেনে ফিরিয়ে আনা যেত ভাইকে, এবারও যদি...
হ্যাঁ, তিনি পারলেন। লেখার মধ্যে দিয়ে হলেও। ভাইয়ের পা দুটো টেনে বের করে আনলেন আগুন থেকে, তারপর পা দুটো ধরেই ভাইকে ছুড়ে দিলেন আকাশে। শরীরে ‘দাউদাউ আনন্দ’ নিয়ে ভাই হেঁটে বেড়াচ্ছে আকাশে। মুক্ত এখন ভাই। সংসার থেকে, রোগবালাই থেকে, কষ্ট থেকে। তিনি দেখছেন। ভাইকে ফিরিয়ে আনার সান্ত্বনা তাঁর অবচেতনে। সে সান্ত্বনা তিনি ফুটিয়ে তুলছেন লেখায়, অক্ষরে। তিনি, জয় গোস্বামী।
অথচ জীবিতকালে এই ভাইয়ের সঙ্গেই কত মনোমালিন্য হত তাঁর। আশির দশকে, যখন ভাই তাঁকে মুখের ওপর বলেছিল আগে নিজে রোজগার করে তারপর খরচ করতে, মনে ব্যথা পেয়েছিলেন তিনি। লিখেছেন সে-কথা। অথচ পরবর্তীকালে, যখন খানিক স্বচ্ছল হলেন জয়, তখনও মনের মধ্যে কুণ্ঠা কাজ করেছে হাজারবার। শুধু ভাইকে নিয়েই নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে
"নৈতিকভাবেও আর এই শব্দটির সঙ্গে, কবিতা রচনা কাজটির সঙ্গে যুক্ত থাকার অধিকার আমি সেদিন হারালাম।"
একবার, ১০,০০০ টাকার বিনিময়ে এক যুবকের নতুন কবিতার বই উদ্বোধন করতে রাজি হয়েছিলেন তিনি। সেই যুবকের লেখা আগে পড়েননি। অথচ বইয়ের উদ্বোধন-অনুষ্ঠানে গিয়ে দুটো ভালো কথা বলতে হয়েছিল। পড়তে হয়েছিল কবিতাও। ফেরার সময়, যুবক ১০,০০০ টাকা খামে ভরে তুলে দেন জয়ের হাতে। পরবর্তীকালে এ-নিয়ে অনুশোচনায় ভুগেছেন জয় গোস্বামী। লিখেছেন – ‘কবি শব্দটি আমার নামের সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত নয়, তা বুঝতে পারি, নিজের কবিতা পড়ে। কিন্তু, নৈতিকভাবেও আর এই শব্দটির সঙ্গে, কবিতা রচনা কাজটির সঙ্গে যুক্ত থাকার অধিকার আমি সেদিন হারালাম।’
ওই গদ্যেরই শেষের দিকে তিনি লিখছেন – ‘পাঠক, আপনি আমার আয়না। সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই আমি আমার সব কথা বলে যাচ্ছি।’ সত্যিই তাই। সাধারণত কবিরা নিজেদের কবিতার মধ্যে, সংকেতের আকারে ‘কনফেশন’ রেখে যান। সেখানে জয় ব্যতিক্রম। গদ্যের পর গদ্যে তিনি নিজেকে কেটেছেন, ছিঁড়েছেন। ভালোয়-মন্দে নিজের রূপটাকে তুলে এনেছেন তিনি। হ্যাঁ, আংশিক, তবুও। কেউ কেউ বলেন, এই আত্মসমালোচনা জয়ের নিজেকে ‘বিশেষ’ করে তোলার নতুন পথ। কিন্তু যে-আয়নার জন্য এসব লেখেন তিনি, সেই পাঠক কি সাহিত্যজগতের সেসব কচাকচির মধ্যে যেতে চায়? সে যতটুকু জানতে পারে লেখার মধ্যে দিয়ে, সেটুকুই তার সম্বল।
আরও পড়ুন
কবিতা কি বাবার লিখে দেওয়া নাকি মায়ের নকল - 'বুনো' নবনীতা ও উত্তরাধিকারের গল্প
আর এভাবেই, নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছেন জয় গোস্বামী, আজও। গল্পে-উপন্যাসে অন্য চরিত্রের মধ্যে দিয়ে, আর গদ্যে সরাসরি নিজেকে ফুটিয়ে তুলছেন। এও এক বিরল ক্ষমতা। তাঁর লেখায় সরাসরি উঠে এসেছে তাঁর যাপন। রানাঘাটের সেইসব মফঃস্বল-মাখা দিন। চুর্ণি নদীর ঘাট। সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। দূরের মাঠের আলপথ দিয়ে, একলা কোনো মেয়ের হেঁটে চলে যাওয়া। সম্পর্কের জন্ম, মৃত্যু। বাবার মৃত্যু, মায়ের মৃত্যু, সব শেষে ভাইয়ের মৃত্যু। না, শোককে মহান অনুভূতিতে উত্তীর্ণ করার চেষ্টা করেননি তিনি খুব বেশি। সারল্যই ব্যথা এনে দিয়েছে তাঁর কবিতায়। কনফেশনময় তাঁর লেখক-জীবন। অন্তত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। তাই আত্মীয়বিয়োগ এভাবে ফুটে ওঠে তাঁর লেখায় –
"খেতে বসতে গিয়ে আজকে বাষট্টি বছরের
এক বৃদ্ধ দেখছে তার থালার তিনদিকে
মাটির তিনটি সরায় ভরে রাখা
তিনজনের পোড়া অস্থি, ছাই..."
শুরুতে যার কথা বলছিলাম, জয়ের ভাই, যাকে শৈশবে বাঁচিয়েছিলেন মৃত্যুর হাত থেকে, পরিণত বয়সে সেই ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি লিখলেন –
আরও পড়ুন
কবিতার সূত্রে সম্পর্ক, বিরহেই অমরত্ব পেয়েছিল দাগ দিলভি ও মুন্নিবাই-এর প্রেম
"আকাশ ভেঙে শিলাবৃষ্টি
বাতাস ভাঙলে ঝড়
ঝড়ের কথায় কান না দিয়ে
দৌড়ে দৌড়ে শিল কুড়িয়ে খাই
তাইরে নাইরে নাই
আমি, আমার ভাই
কাদায় মাখা শিল কুড়িয়ে খাই
ভাই যে আমার নাই রে নাই রে নাই!"
আর আমি, ক্ষুদ্র এক পাঠক, এই কবিতায় হারিয়ে যেতে যেতে কেবলই অনুভব করছি এক ধাক্কা। বুকের মধ্যে। হাহাকার যেন বা। ফাঁকা ঘরে শব্দ হলে যেমনটি হয়, ঠিক তেমন। ‘ভাই যে আমার নাই রে নাই রে নাই।’
নাই নাই নাই – আমার ভিতরকার এই প্রতিধ্বনি কি ফিরে যাচ্ছে কবির কাছে? যায় কি? কে জানে!
আরও পড়ুন
‘ঢের হয়েছে’, মাত্র ৩৮ বছর বয়সেই কবিতা লেখা ছেড়ে দিলেন সমর সেন
ঋণ – রানাঘাট লোকাল - জয় গোস্বামী, আমরা সেই চারজন – জয় গোস্বামী
Powered by Froala Editor