দুর্গার বিকল্প জগদ্ধাত্রী, কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরেই ‘পরাধীন’ বাংলায় শুরু পুজো

উৎসবের মরসুম এবার ফুরনোর পথে। আজ জগদ্ধাত্রী পুজো।  চন্দননগর তো বটেই, সেই সঙ্গে সামিল হয়েছে কৃষ্ণনগর, কলকাতা-সহ গোটা জায়গা। সেই জগদ্ধাত্রী পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ইতিহাস, নানা মিথ। জড়িয়ে বাংলার ঐতিহ্যও।

চন্দননগর জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য বিখ্যাত হলেও, এর শুরু কিন্তু এখানে নয়। সেই কৃতিত্বের দাবিদার কৃষ্ণনগর। সেই সূচনার সময়কাল নিয়েও শোনা যায় নানা মতবাদ, নানা লোককাহিনি। প্রচলিত মত অনুযায়ী, জগদ্ধাত্রী এবং অন্নপূর্ণা— বঙ্গে এই দুটো পুজোরই সূচনা করেছিলেন কৃষ্ণনগরের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়। তার আগে বিভিন্ন পুঁথি, গ্রন্থে জগদ্ধাত্রীর উল্লেখ থাকলেও, তাঁর আরাধনার কোনো প্রচলন ছিল না। সেটা প্রথম শোনা যায় কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে। প্রচলিত মত অনুযায়ী, একবার দুর্গাপূজার আগে মুর্শিদাবাদের নবাবের হাতে বন্দি হন কৃষ্ণচন্দ্র। অভিযোগ ছিল নবাবকে কর না দেওয়া। ততদিনে বাংলার গৌরবসূর্য অস্তমিত। পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত সিরাজ। সেই ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রও। পরবর্তীকালে মীরকাশিমের হাতে আবার বন্দি হন তিনি। সেবার সমস্ত মিটমাট করে, মহানবমীর একেবারে শেষ বেলায় কৃষ্ণচন্দ্র মুক্তি পেলেন। পুজো দিতে পারেননি, এই ভেবে মন খারাপ। কিন্তু অন্তত মায়ের মুখটা যেন দেখতে পারেন, সেই প্রার্থনাই করছেন তিনি। কিন্তু সেটাও পূরণ হল না। যখন কৃষ্ণনগর পৌঁছলেন, ততক্ষণে প্রতিমার বিসর্জন হয়ে গেছে। আশাহত হলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। সেইদিনই রাতে স্বপ্ন পান তিনি। দেখেন, এক কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে তাঁর দিকে তাকিয়ে। ধীরে ধীরে সেটা মিলিয়ে দেখা দিলেন চতুর্ভুজা, সিংহবাহিনী দেবীমূর্তি। স্বপ্ন ভেঙে রাজা ঘোরের মধ্যে থাকলেন। পরে সেই স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে পুজো করলেন কৃষ্ণচন্দ্র। সেই শুরু জগদ্ধাত্রী পুজোর। পরবর্তীকালে যা ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলায়।

ওপরের কাহিনি কতটা মিথ, সেটা গবেষণার বিষয়। তবে কিছু কিছু ব্যাপারে ইতিহাস গবেষকরা মনোনিবেশ করেছেন। যেমন, মুর্শিদাবাদের নবাব। কৃষ্ণচন্দ্র দু’বার বন্দি হয়েছিলেন— ১৭৫৪ সালে (মতান্তরে ১৭৫৬) আলিবর্দির হাতে, আর একবার ১৭৬৩ সালে মীরকাশিমের আমলে। অনেকে আবার বলেন, আলিবর্দি নয়, বরং সিরাজের হাতে বন্দি হয়েছিলেন তিনি। সে যাই হোক, গবেষকদের মত অনুযায়ী মীরকাশিমের হাত থেকে যখন মুক্তি পান, তারপরেই নাকি জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন কৃষ্ণচন্দ্র। শুরু হয় তাঁর ‘রাজরাজেশ্বরী’-এর পুজো। আজও যে নামে কৃষ্ণনগরের মানুষ পূজা করেন জগদ্ধাত্রীর।  

আবার এমনও শোনা যায়, কৃষ্ণচন্দ্র নাকি কারাগারের মধ্যেই চতুর্ভূজা মায়ের সাক্ষাৎ পান। দেবী তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন তিনি মুক্তি পাবেন। আর সত্যিই কিছুদিনের মধ্যেই মুক্তি পান তিনি। তারপর দেবীর সন্ধান করতে হাজির হন কালীশঙ্কর নামে এক ব্রাহ্মণের কাছে। তিনিই জগদ্ধাত্রী পুজোর পরামর্শ দেন। এমনকি পৌরোহিত্যও করেছিলেন তিনি। অবশ্য অনেকে মনে করেন, আলিবর্দির হাত থেকে মুক্তির পর যদি জগদ্ধাত্রী পুজোর শুরু হয়, তাহলে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে নিশ্চই তার উল্লেখ থাকবে। ফলে ১৭৫২ সালের আগে পুজোর শুরু, একথা মেনে নেওয়া যায় না। আবার পলাশির যুদ্ধের পর কৃষ্ণচন্দ্রের আর্থিক জৌলুস হারিয়ে যায়। ফলে মীরকাশিমের সময়ের যুক্তিও মেলে না।

কবি কান্তিচন্দ্র অবশ্য কৃষ্ণচন্দ্রের নাতি গিরীশচন্দ্রকে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবক্তা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু গবেষণা বলছে পুজো শুরু হয়ে গিয়েছিল তার আগেই। ইতিহাস, মিথ, ঐতিহ্য— সবকিছু একসঙ্গে মিলে মিশে গেছে উৎসবের সঙ্গে। আঠারো শতকে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের হাত ধরে যে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হয়েছিল, তা আজ গোটা বাংলায় সাড়ম্বরে পালিত হয়। সময়ের সঙ্গে হয়ত পাল্টে যায় আরও অনেক কিছু। কিন্তু সেসবকে মাথায় নিয়েও আজও বেঁচে আছে এই ইতিহাস।

তথ্যসূত্রঃ
১. ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কিন্তু জগদ্ধাত্রী পুজোর কথা বলে না, দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
২. কৃষ্ণচন্দ্র ও জগদ্ধাত্রী পুজো, বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার

আরও পড়ুন
মূর্তি নয়, পুজো হত পদচিহ্নেই; ধীরে ধীরে আলপনায় মিশে গেল লক্ষ্মীর পা

Powered by Froala Editor