ব্রিটিশ-শাসন-পীড়িত ভারতবর্ষে উপনিবেশ-বিরোধী যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান, তাতে স্বদেশ বা স্বভূমি নামক ভৌগোলিক-রাজনৈতিক ধারণাটি কেবলমাত্র একটি বিমূর্ত তত্ত্ব হয়ে থাকেনি। বহু মনীষীর লেখালেখির সূত্রে স্বদেশ হয়ে উঠেছে দেশমাতা, সর্বজনীন মা। ব্যক্তিত্ব আরোপের পাশাপাশি ঘটেছে দেবত্ব আরোপও। বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখের কলমে ভারতমাতা হয়ে উঠেছেন বেদ-পুরাণ-তন্ত্রসম্মত শাস্ত্রীয় দেবী দুর্গারই বিশেষ এক প্রকাশ। সেকালের জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দেশসেবা তাই মাতৃপূজা— যে পূজার মূলমন্ত্র ‘বন্দে মাতরম্’।
পার্বতী-পুত্র গণপতির শাস্ত্রসম্মত আবির্ভাব তিথিটি হচ্ছে ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্থী। এই তিথির নামান্তর তাই গণেশচতুর্থী (Ganesh Chaturthi), বা বিনায়কচতুর্থী। বাৎসরিক গণপতি-আরাধনার এই তিথিকেই লোকমান্য তিলক (Bal Gangadhar Tilak) তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় সর্বজনীন গণেশ উৎসবে পরিণত করেন।
পুরাণের গণেশ— তিনি দুর্গাপুত্র, তিনি মাতৃবৎসল। শিবপুরাণে তাঁর বহুখ্যাত আবির্ভাব-কাহিনিতে দেখি, মায়ের আদেশে, মায়ের মর্যাদা রক্ষার্থে মাতৃসেবক গণেশ ইতোমধ্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত দেবসৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন, এবং সহর্ষে, নির্ভয়ে সেই সংঘর্ষে আত্মাহুতি দিয়েছেন। মাতৃভূমির মর্যাদা পুনরুদ্ধারে ব্রিটিশ-বিরোধী মুক্তিযোদ্ধাদের একের পর এক নির্ভয় আত্মাহুতির সঙ্গে গণেশের এই যুদ্ধ ও আত্ম-বিসর্জনের কাহিনি কোথাও গিয়ে যেন এক হয়ে যায়। পুরাণকথার গণেশ হয়ে ওঠেন অগ্নিযুগের ঐতিহাসিক বিপ্লবী-গোষ্ঠীর প্রোটোটাইপ।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, শিবাজী মহারাজের সময়েও মহারাষ্ট্রের পুনে নগরীতে গণেশ উৎসব পালিত হত। অষ্টাদশ শতকে পেশোয়া শাসকদের রাজকীয় অর্থানুকূল্যে গণেশ চতুর্থীর যে সাড়ম্বর উদযাপন হত, ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার ফলে তা অনেকাংশে স্তিমিত হয়। কিন্তু, পুনের জনতা নিজেদের পারিবারিক পরিসরের মধ্যে এই পূজাপার্বণ অবিচ্ছিন্নভাবে জারি রাখে। ১৮৮৬ সালের বোম্বে গেজেটে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যাচ্ছে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে পারিবারিক গণেশবিগ্রহ নিয়ে পুনের জনসাধারণের আনন্দোচ্ছ্বল শোভাযাত্রার বিবরণ। স্বাধীনতা-যুদ্ধের অন্যতম নেতা বালগঙ্গাধর তিলক এই ধর্মীয় আবেগকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অঙ্গনে উদযাপন করতে চাইলেন। ১৮৯৩ সালে তাঁর সম্পাদিত 'কেশরী' পত্রিকায় তিনি সর্বজনীন গণেশপূজার সপক্ষ্যে বক্তব্য রাখলেন, শুরু হল মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত গণেশ উৎসব। তিলকের মতে, গণেশের নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে তিনি গণদেবতা, জনসাধারণের দেবতা। তাই এই উৎসব কেবল ধর্মীয় পার্বণ মাত্র নয়, এ হল ভারতবাসীর জাতীয়তাবোধ ও ঐক্যচেতনা জাগিয়ে তোলার উৎসব।
আরও পড়ুন
১৪টি রাজ্যের নাটক নিয়ে জাতীয় উৎসব নৈহাটির ‘রঙ্গসেনা’র
তিলকের এই প্রয়াসে কেবল মহারাষ্ট্রে নয়, ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও বিপুল উৎসাহে গণেশ উৎসব আরম্ভ হয়। মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র-শিল্পীদের ঘরে ঘরে মহা আড়ম্বরে উদযাপিত গণেশপূজার কথা আজ সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে সকলেই জানেন। এই উৎসবের একটি বিশেষত্ব হল, গণেশকে উৎসর্গ করা হয় 'মোদক' নামক এক বিশেষ মিষ্টান্ন। চালগুঁড়ো, আটা, নারকেলকোরা, গুড় ইত্যাদির সংমিশ্রণে তৈরি হয় এই মোদক। সপ্তদশ শতাব্দীর সাধক কবি সমর্থ রামদাস রচিত ‘সুখকর্তা দুখহর্তা’ মারাঠি ভজন এই পূজার অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠেছে। সমুদ্র বা নদীতে ‘নিমজ্জনম্’ অর্থাৎ মূর্তি বিসর্জন বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্ন ওঠায়, বর্তমানে ক্ষতিকর রাসায়নিক বাদ দিয়ে গোবর, মাটি ও পরিবেশ-বান্ধব রঙ ব্যবহার করে বিগ্রহ নির্মাণের রীতি শুরু হয়েছে। কোনো কোনো ধনী পরিবারে বিগ্রহ আদৌ বিসর্জিত হয় না, নির্দিষ্ট জলাধারে রেখে গলিয়ে ফেলা হয়। পরে, পারিবারিক বাগানে ব্যবহৃত হয় সেই জল ও মাটি।
আরও পড়ুন
কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের সিনেমা
গণেশকে নিয়ে মধ্যযুগ থেকেই বাঙালির আবেগও কিছু কম নয়। প্রতিটি মঙ্গলকাব্যের বন্দনা অংশ কবিরা আরম্ভই করেছেন গণেশ বন্দনার মাধ্যমে। কবি ভারতচন্দ্র বিরচিত অন্নদামঙ্গলের গণেশবন্দনা অংশ থেকে তুলে আনা যাক কয়েকটি চিত্তাকর্ষক পংক্তি—
আরও পড়ুন
সাও পাওলো চলচ্চিত্র উৎসবে সেরার পুরস্কার তিন বাঙালির
"হেলে শুণ্ড বাড়াইয়া সংসার সমুদ্র পিয়া
খেলাছলে করহ প্রলয়।
ফুৎকারে করিয়া বৃষ্টি পুন কর বিশ্বসৃষ্টি
ভালো খেলা খেল দয়াময়।।"
কবির দৃষ্টিতে, এক গজশিশুর আমোদিত জলকেলির দৃশ্যেই আভাসিত হয়েছে বিরাট বিশ্বনিয়ন্তার স্বরূপ, ক্রমাগত ধ্বংস ও পুনঃসৃজন যাঁর অনাদি অনন্ত ক্রীড়াকৌতুক।
পয়লা বৈশাখ এবং অক্ষয় তৃতীয়া, এই দুটি হল বাঙালি ব্যবসায়ী সমাজের ঐতিহ্যবাহী গণেশ পূজার দিন। গণেশ বিঘ্নহর্তা এবং সিদ্ধিদাতা— তাঁর এই দুই বিশেষত্ব মাথায় রেখেই বাৎসরিক বণিকবৃত্তির সূচনায় তাঁর আরাধনা। তবে এখন বিশ্বায়নের যুগ, তাই ভাদ্রমাসের গণেশ চতুর্থীও এখন কলকাতা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের বাঙালি সমাজে প্রবেশ করেছে। কখনও তা সর্বজনীন উৎসব, কখনও বা পারিবারিক।
Powered by Froala Editor