১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে জড়ো হয়েছেন বহু মানুষ। বৈশাখী উৎসবের আবহ, সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে প্রতিবাদ। ব্রিটিশ সরকারের রাওলাট অ্যাক্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আর তার জন্যই শান্তিপূর্ণ জমায়েত করেছিলেন সাধারণ মানুষরা। সেখানেই সবার মধ্যে পানীয় জল বিতরণের কাজ করছিলেন বছর উনিশের এক তরুণ।
হঠাৎই মাঠের প্রবেশপথের দিকে নজর গেল সবার। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশ পুলিশের বাহিনী। প্রত্যেকে সশস্ত্র; বন্দুক তাগ করা নিরস্ত্র মানুষগুলোর ওপর। সামনে এগিয়ে এলেন জেনারেল ডায়ার। স্রেফ একটাই শব্দ শোনা গেল— ‘ফায়ার’! বাকি কেবল বন্দুকের গর্জন, আর অজস্র মানুষের হাহাকার। বেরনোর একটাই রাস্তা, আর সেই রাস্তা আটকে রেখেছে ব্রিটিশরা। ঘটে গেল ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যালীলা। সেইসময় ওই মাঠে দাঁড়িয়েই পুরো দৃশ্য দেখেছিলেন বছর উনিশের ওই তরুণ, উধম সিং। চারিদিকে রক্ত, মৃত্যু; আর তারই পাশে দাঁড়িয়ে আছেন জেনারেল ডায়ার।
সেদিন পাঞ্জাবের গভর্নর ছিলেন আরেক ডায়ার। মাইকেল ও'ডায়ার। কে জানত, কিশোর উধমের মনে জন্ম নিচ্ছে অন্য আগুন?
নিয়তির যাত্রা যেন সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। অদ্ভুতভাবে ওই গুলি এসে লাগেনি তরুণ উধম সিংয়ের গায়ে। আর লাগেনি বলেই তৈরি হয়েছিল ইতিহাস। সেখানে আসার আগে একটু পাদপূরণ করে নেওয়া যাক। পাঞ্জাবের অখ্যাত গ্রামে এক শিখ পরিবারে জন্ম হয় উধম সিং। অবশ্য তখন তাঁর নাম ছিল শের সিং। ভাগ্যের কি অদ্ভুত পরিহাস! খুব ছোটো বয়সেই মা-বাবাকে হারান তিনি। যে বড়ো দাদার হাত ধরে অনাথ আশ্রমে এসে ঠাই নিয়েছিলেন, সেই দাদাও চলে গেলেন বড্ড তাড়াতাড়ি। সেই অনাথ আশ্রমেই শের সিং বদলে গেলেন উধম সিং-য়ে। বদলে গেল জীবনের গতিপ্রকৃতিও…
জালিয়ানওয়ালাবাগ যেন উধম সিংয়ের জীবনে একটা ঝড় নিয়ে আসে। মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা জেনারেল ডায়ারের দিকে তাকিয়ে আসল প্রতিজ্ঞাটা বোধহয় সেদিনই নিয়েছিলেন। এই নারকীয় ঘটনার প্রতিশোধ তিনি নেবেনই, যে করেই হোক। মানুষগুলো তো কাউকে আক্রমণ করেনি! কারোর কাছে অস্ত্রও ছিল না। হাজার হাজার বৃদ্ধ, তরুণ, মহিলা, শিশুকে এভাবে নির্বিচারে মেরে ফেলা হল। এবং তারপরও জেনারেল ডায়ারের মনে কোনো অনুশোচনা নেই! এ হতে পারে না। উধম সিংয়ের শিরায় শিরায় তখন আগুন জ্বলছে। প্রতিশোধ তিনি নেবেনই।
এরপর জীবনে আসে অনেক বাঁকবদল। পাঞ্জাবের গদর পার্টির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা উধম সিং বিপ্লবী আন্দোলনের পরিকল্পনা করতে থাকে। ভারতে ব্রিটিশদের অত্যাচারের খবর পৌঁছে দিতে থাকেন বিদেশে থাকা ভারতীয়দের কাছে। শুধু তাই নয়, সেখান থেকে অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারেও তদারকি করতে থাকেন। এই সময়ই উধম সিং চলে যান আমেরিকায়। এক জাহাজ কোম্পানির কর্মী হিসেবে শুরু হয় কর্মজীবন। কিন্তু সে তো বাইরের রূপ। এই কাজের সূত্রেই নানা জায়গা ঘুরতে লাগলেন উধম সিং। কখনও ইউরোপ, কখনও আমেরিকা, কখনও আবার এশিয়ার অন্যান্য দেশ। আর এই সূত্রেই বিপ্লবী আন্দোলন, গদর পার্টির অন্যান্যদের সঙ্গে আলাপ করেন তিনি। সঙ্গে মজুত হতে থাকে অর্থ এবং অস্ত্রভাণ্ডার…
আরও পড়ুন
তর্কযুদ্ধে নেমেছিলেন খোদ টলস্টয়ের বিপক্ষে, বিস্মৃতির অতলে বিপ্লবী তারকনাথ দাস
এরই মধ্যে ভারতে ফিরে আসেন উধম সিং। কিন্তু পুলিশ এবার সতর্ক হয়েই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্য কারাবন্দি করা হয় উধম-কে। মুক্তি পাওয়ার পর ঠিক করেন, আর ভারতে থাকা যাবে না। কারণ পুলিশ তাঁর গতিবিধির ওপর কড়া নজর রেখেছে। এই অবস্থায় কিছু করতেও পারবেন না তিনি। না, তাঁকে যে করেই হোক পালিয়ে যেতেই হবে। এই সময় গা ঢাকা দেওয়ার জন্য সিনেমায় অভিনয়ও করেন। ‘এলিফ্যান্ট বয়’ এবং ‘দ্য ফোর ফাদার্স’ নামের দুটি সিনেমায় কাজ করেন তিনি। সামান্য চরিত্র, সেরকম কিছু নয়; আর উধম সিং অভিনয়ের স্বপ্নও দেখেননি কোনদিন। তাঁর তখন একটাই লক্ষ্য, যে করেই হোক পুলিশদের চোখকে ফাঁকি দিতে হবে। আর তার জন্য যা করার দরকার হয় তাই করবেন…
শেষ পর্যন্ত ফাঁকি দিতে পেরেছিলেন তিনি। ইউরোপে পৌঁছে, জার্মানি হয়ে ১৯৩৪ সাল নাগাদ উধম সিং পৌঁছন লন্ডনে। এবং এখানে পৌঁছেই জানতে পারেন, আরও একজন সেই মুহূর্তে লন্ডনে বসবাস করছেন। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং ডায়ার! গায়ের রক্ত আবার গরম হয়ে উঠল। এতদিন যে প্রতিশোধের স্পৃহা তাঁকে ঘুমোতে দিত না, সেই মানুষটি আজ লন্ডনে উপস্থিত। তাঁর চোখের সামনে ওরকম বর্বর হত্যালীলা চালালেন যিনি, তাঁর শেষ দেখে ছাড়বেন। সেই দিনটি থেকে উধম সিং-এর লক্ষ্য একটাই— ডায়ারের নিধন…
কিন্তু না, গুলিয়ে ফেলেছিলেন উধম। জেনারেল ডায়ার মারা গিয়েছেন আগেই। লন্ডনে তখন বসবাস করছেন সেদিনকার পাঞ্জাবের গভর্নর, মাইকেল ও'ডায়ার।
আরও পড়ুন
ক্ষুদিরামকে নিয়ে সিনেমা, তথ্যের যোগান দিলেন বিবেকানন্দ ও অরবিন্দের বিপ্লবী ভাইয়েরা
১৯৪০ সাল। দিনটি ১৩ মার্চ। লন্ডনের ক্যাক্সটন হলের লাল বাড়িটিতে বক্তৃতার আসর বসেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন এবং সেন্ট্রাল এশিয়ান সোসাইটির যুগ্ম এই বক্তৃতায় হাজির হয়েছিলেন মাইকেল ও’ডায়ার। নির্দিষ্ট সময় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য উঠলেন; হঠাৎই হলঘর কেঁপে উঠল গুলির আওয়াজে। সবাই তাকিয়ে দেখলেন, এক ভারতীয় দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। এক হাতে বই, আরেক হাতে বন্দুক। এই পিস্তল থেকেই দুটো গুলি ছুটে গেছে মাইকেল ও’ডায়ারের দিকে। অব্যর্থ নিশানা! সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ডায়ার। প্রতিশোধ সম্পূর্ণ! তখনও দাঁড়িয়ে রইলেন ওই ভারতীয়, উধম সিং। তাঁর পিস্তল সম্পূর্ণ খালি করলেন। পালানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলেন না। তাঁর যা লক্ষ্য ছিল, তা আজ সম্পূর্ণ হয়েছে…
১৯৪০ সালের ৩১ জুলাই, তাঁর ফাঁসি হওয়ার আগে বিস্তর অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে উধম সিংকে। তিনি কেন এই কাজ করেছেন, সেইসঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ের মূল মন্ত্র— সমস্ত কিছু শহিদ হওয়ার আগে বলে গিয়েছেন বিশ্ববাসীকে। উধম সিং আজও ভারতের এক বীর বিপ্লবী। জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো ঘটনার চরম প্রতিশোধ নিয়েছেন যিনি, তাঁকে কি করে অস্বীকার করা যায়!
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ফাঁসিতে প্রাণ দেওয়া দ্বিতীয় বাঙালি বিপ্লবী, চিতাভস্ম কিনতে ভিড় কেওড়াতলায়