তখনও শৈশবদশা কাটেনি কলকাতার। পয়লা বৈশাখের অস্তিত্ব থাকলেও, পয়লা জানুয়ারির প্রচলন ছিল না মোটেই। খুব স্বাভাবিকভাবেই, এই প্রথার শুরু ব্রিটিশ আমলে। বলা ভালো, যেদিন থেকে ভারতের বুকে বিদেশি বণিকরা পা দিল, তখন থেকেই পাশ্চাত্যের ধারা মিলে গেল আমাদের সঙ্গে। আর ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় তো আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ল। নিজেদের দেশ থেকে এতটা দূরে; যতই ‘সোনার হাঁস’ হোক, ভারতের আবহাওয়া তো সম্পূর্ণ আলাদা। বিশেষ করে বলতে হবে কলকাতার কথা। যে শহর একটা সময় বিদেশি শাসকদের রাজধানী ছিল…
কলকাতায় তখন ইংরেজদের পরিস্থিতি কেমন ছিল, তার বর্ণনা বিভিন্ন বইতে পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে আছে শহরের বুকে ছড়িয়ে থাকা বেশ কিছু গোরস্থান। এই দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে অনেকেই মারা গিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে ছিল নিজের জন্মভূমি থেকে দূরে থাকার কষ্ট। এতকিছুর মধ্যেই সরকার ঠিক করলেন, কলকাতাকে ঢেলে সাজাতে হবে। আর সেইসঙ্গে বিলেতের যাবতীয় উৎসব আয়োজন করতে হবে। তাহলে যদি সবার মন ভালো থাকে…
এবং, এই চিন্তা থেকেই তিলোত্তমায় পা রাখল ক্রিসমাস এবং ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন। এখনকার মতো আলোর মালায় হয়তো সেজে উঠত না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে সবাই জড়ো হতেন এক জায়গায়। নিজেদের বাড়িতে তো বটেই; হোটেলেও ঢালাও আয়োজন করা হত। ইতিহাস বলে, শহরের দুটি জায়গায় ইংরেজরা একসঙ্গে জড়ো হতেন ক্রিসমাস আর নববর্ষ উদযাপনের জন্য। একটি হল গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল, আরেকটি রাজভবন। রকমারি খাবার, পানীয়, কেক তো থাকতই; সেইসঙ্গে চলত গান-বাজনা। এমনকি, ঊনবিংশ শতকের বিখ্যাত ইতালিয়ান গায়িকা সিগনোরা ভেঞ্চুরাও এসেছিলেন কলকাতায়। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল ক্যালকাটা টাউন ব্যান্ড।
কলকাতার বুকে আস্ত ক্রিসমাস ট্রি আনার তো কোনো প্রশ্নই নেই। মন্দের ভালো ছিল দেবদারু গাছ। ব্রিটিশদের দৌলতে এই গাছটিই হয়ে গেল ‘ক্রিসমাস ট্রি’। নববর্ষের প্রাক-মুহূর্তেও এই গাছটি সঙ্গী হত। একটু একটু করে যখন গির্জাগুলো তৈরি করা শুরু হল, তখন এই আড়ম্বর আরও বেড়ে গেল। ঘোড়দৌড়ের মাঠে চলত এলাহি আয়োজন। ‘হোয়াইট টাউনের’ এমন আয়োজন দেখে বাকি শহরের কী অবস্থা ছিল, সেটা অবশ্য জানা যায় না।
বাংলা নববর্ষ এলে বাড়ি-ঘর যেমন পরিষ্কার করা হয় ভালো করে, নতুন জামা-কাপড় পরা হয়, ইংরেজি নববর্ষেও তেমনই। ‘গ্রিটিংস কার্ড’ আসার আগে একে অন্যকে চিঠি লিখে শুভেচ্ছা জানাতেন ব্রিটিশরা। চিঠির সঙ্গে উপহারও পাঠাতেন তাঁরা। নিউ মার্কেটের মতো বাজার উপচে পড়ত। পরবর্তীতে কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী চলে যাওয়ার পরও কলকাতার জাঁকজমক কমেনি। হাজার হোক, ইংরেজদের প্রথম রাজধানী বলে কথা!
আর ভারতীয়রা? প্রথমদিকে অবশ্য এইসবে খুব একটা গা ভাসায়নি বাংলার মানুষ। অবস্থা বদলাল যখন একটু একটু করে খ্রিস্টধর্ম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। ভারতীয়রাও খ্রিস্টধর্মের পথ অনুসরণ করল। এবং ইংরেজি নববর্ষ পালনও ঢুকে পড়ল এই দেশে। কলকাতাও অন্যথা ছিল না। তবে মজাদার ব্যাপার হল, এই ক্রিসমাস এবং নববর্ষেও বাঙালি রং লেগে গেল। ক্যারলের জায়গায় শোনা গেল সংকীর্তন। গোঁড়া খ্রিস্টান মহল অবশ্য খানিক বাঁকা চোখেই দেখল এসব। বর্ষবরণের এত জাঁকজমকও পছন্দ হল না তাঁদের। কিন্তু বাঙালি এইভাবেই নতুন রূপ দিল এই উৎসবকে। যোগ দিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাধাকান্ত দেবের মতো বাঙালি জমিদার‘বাবু’রাও। সব মিলিয়ে জৌলুসে, চাকচিক্যে ভরে গেল বর্ষবরণ। বলতে পারেন, তারই প্রতিচ্ছবি আজ দেখছি আমরা।
আরও পড়ুন
কলকাতার বুকেই লুকিয়ে ‘ঘনাদা ক্লাব’, আসতে চলেছে ৭৫ বছরের বিশেষ সংকলনও
তথ্যসূত্র-
১) ‘ঘোড়দৌড়, দুপুর গড়িয়ে নাচ’, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘কয়েকশো বছর আগে ফিরিঙ্গি কলকাতায় বড়দিন, নিউ ইয়ার্স ইভে নগর-কীর্তন হত’, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘Merry Christmas: A look back on Christmas revelries in Calcutta in December, 1857’, Devasis Chattopadhyay, National Herald
Powered by Froala Editor