১৯৪০ সাল। বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে গেছে পৃথিবীর মানচিত্রজুড়ে। আর তার রেশ এসে পড়েছে ভারতেও। ব্রিটিশদের হয়ে এদেশ থেকেও সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। ঠিক এমন একটা সময়েই খবর পৌঁছাল ডেপুটি অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল নগেন্দ্রনাথ সেনের কাছে। তাঁর পঞ্চাদশী কন্যাও নাকি লড়াই করতে চলেছেন ব্রিটিশ ভারতের হয়ে। না, যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, তাঁর লড়াই ময়দানে। হাতে আর মাত্র কয়েক মাস সময়। তারপরেই হেলসিঙ্কিতে বসবে অলিম্পিকের আসর! আর সেখানেই অ্যাথলিট হিসাবে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন ১৯৩৭ ও ’৩৮ সালের বাংলার জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন। তখন থেকেই অবশ্য দেশের খ্যাতনামা পত্রিকাগুলোতে পুরোদমে লেখালিখি চলছে এই তরুণ প্রতিভাকে নিয়ে। তার ওপরে অলিম্পিকে যোগদানের খবর গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল আগুনের মতো।
না, শেষ পর্যন্ত স্বপ্নপূরণ হয়নি সেই ছোট্ট কিশোরীর। বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে যায় ’৪২-এর সামার অলিম্পিক। অধরাই থেকে যায় তাঁর স্বপ্ন। সেদিনের সেই তরুণীটি আর কেউ নন, তিনি ইলা মিত্র। পূর্ব-পাকিস্তানের কৃষক আন্দোলনের কিংবদন্তি নেত্রী। অলিম্পিকে যাওয়া না হলেও, থামল না তাঁর যুদ্ধ। বেথুন কলেজের ছাত্রী যোগ দিলেন সাংসদীয় কমিটিতে। সংস্পর্শে এলেন মার্ক্সবাদের। গোটা দেশটাই যেন তাঁর কাছে হয়ে উঠল লড়াই-এর ময়দান। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কখনও তিনি পরিচয় গোপন করে ছুটে বেড়াচ্ছেন দুর্ভিক্ষের ত্রাণ সংগ্রহের জন্য; আবার কখনও মহিলাদের শেখাচ্ছেন ব্রিটিশ সেনাদের থেকে অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষার কৌশল। শ্রমজীবী মানুষদের জন্য তৈরি করলেন লঙ্গরখানা। আজ যাকে ‘কমিউনিটি কিচেন’ বলেই চিনি আমরা।
’৪৭ সালে ব্রিটিশ শক্তির হাত থেকে স্বাধীন হল ভারত। কিন্তু সংগ্রাম থেমে থাকল না তাঁর। বরং, স্বামী রমেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে জুটি বেঁধে ভূমিহীন কৃষকদের নেতৃত্ব দিয়ে গড়ে তুললেন বৃহত্তর আন্দোলন। জন্ম নিল তেভাগা। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, যাঁদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সেই জোতদার-জমিদাররা সকলেই যে প্রশাসনের ছত্রছায়ায়। ফলত, রাষ্ট্রের চোখে শত্রু হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি তাঁর। এমনকি মুসলিম লিগ সেসময় নিষিদ্ধ হিসাবে ঘোষণা করে কমিউনিস্ট পার্টিকে।
তখন সাঁওতাল পরগনার এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পরিচয় গোপন করে ছুটে বেড়াচ্ছেন সাঁওতালদের ‘রানি মা’ ইলা। কিন্তু খুব বেশি দিন নজর এড়িয়ে চলতে পারলেন না প্রশাসনের। ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি। নাচোল রেলস্টেশনে ধরা পড়ে গেলেন ইলা মিত্র। তারপরই শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। লক-আপের মধ্যে কখনও রাইফেলের বাট দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়েছে তাঁর হাত। কখনও আবার পেরেক ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তাঁর পায়ের গোড়ালিতে। সেইসঙ্গে গণধর্ষণের শিকার হওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। তবে এতকিছুর পরেও তাঁর মুখ থেকে বিন্দুমাত্র তথ্য বার করতে পারেনি পুলিশ প্রশাসন।
আরও পড়ুন
২৮ জুন, ১৯৬৯ : সমকামীদের ওপর পুলিশি বর্বরতা আমেরিকায়, জন্ম নিল প্রাইড আন্দোলন
পরবর্তীতে সুস্থ হওয়ার পর রাজশাহী কোর্টে নারকীয় এই অত্যাচারের সবিস্তার বিবরণ দিয়েছিলেন স্বয়ং তিনি। তিনি এই উপমহাদেশের প্রথম মহিলা যিনি আদালতে জনসমক্ষে ব্যক্ত করেছিলেন ধর্ষণ অভিজ্ঞতা। কিন্তু তারপরেও ৭ বছর জেল হেফাজতে থাকতে হয় তাঁকে।
আরও পড়ুন
রক্তক্ষয়ী আন্দোলন, নাকি ‘গ্রীষ্মকালীন ছুটির অবসর’? বিপ্লবের অন্য নাম ‘মে-৬৮’
ইলা মিত্রের এই সংগ্রামই পরবর্তীতে বামপন্থী আন্দোলনের পাথেয় হয়ে ওঠে। তাঁকে নিয়ে লেখালিখি হতে থাকে একাধিক পত্রপত্রিকায়। ১৯৬২ সালে মানিকতলা বিধানসভা থেকে নির্বাচনে জিতে বিধায়কও হন তিনি। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত মানিকতলারই জনপ্রতিনিধি হয়ে ছিলেন ইলা। তারপরই হঠাৎ করেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে সম্পূর্ণ ভাবে মুছে যায় তাঁর অস্তিত্ব। আর সুযোগ আসেনি নির্বাচনে দাঁড়ানোর। বা বলা ভালো, তাঁকে সেই সুযোগ আর দেয়নি ক্ষমতাশীল প্রশাসন। আর সাধারণ মানুষ? না, কোনো রাজনৈতিক চরিত্র নয়, বরং খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে তিনি বিপ্লবের মূর্ত প্রতীক হয়ে রয়েছেন স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও…
আরও পড়ুন
গোড়ালিতে পেরেক ঢুকিয়ে দিল পুলিশ, তবু মুখ খুললেন না ইলা মিত্র
তথ্যসূত্র :
Athlete Ila Mitra missed the 1940 Olympics, but became an indomitable peasant leader, Sohini Chattopadhyay, The Hindu
Powered by Froala Editor