আকবরের হাত ধরেই জন্ম বাংলা ক্যালেন্ডারের, হয়ে উঠল বাংলা সংস্কৃতির অঙ্গ

নববর্ষ, হালখাতা এবং মিষ্টির প্যাকেটের সঙ্গে বাংলা ক্যালেন্ডার— এই জুড়ি বোধহয় ভাঙার নয় কখনোই। বাংলার সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠলেও, এই জায়গায় পৌঁছতে ক্যালেন্ডারের চেহারা আর রূপ বদলে গিয়েছে বারবার। এমনকি ইতিহাসে তার তাৎপর্য এবং গুরুত্বও অনেকটাই। 

মূলত বাংলা ক্যালেন্ডারের সূচনা সপ্তম শতকে বঙ্গের শাসক শশাঙ্কের হাত ধরে শুরু হলেও, ইতিহাস কবেই বা সরল সোজা পথে চলতে স্বীকার করেছে! তাই ভাবতে আশ্চর্য লাগলেও, সত্যি এটাই যে, আধুনিক বাংলা ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেছিলেন বাঙালি কোনো শাসক নন, বরং দিল্লীশ্বর স্বয়ং সম্রাট আকবর! কীভাবে? পিছনে ফিরে দেখা যাক। 

আকবরের শাসনের দুই দশক পার হয়ে গেছে তখন। মুঘল বংশের তৃতীয় সম্রাট আকবরের পরিধি বাড়িয়ে চলা সাম্রাজ্য ততদিনে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য। কিন্তু শুধুমাত্র সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং সাম্রাজ্য বিস্তারেই মন ছিল না আকবরের। বরং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই বিস্তীর্ণ সীমাভূমিতে সুশাসনের জন্য দরকার বৌদ্ধিক ভাবে উন্নত হওয়া। এই উন্নতির নিরিখে আকবর হাতিয়ার করলেন তিনটি মূল মন্ত্র: ধর্ম, দর্শন এবং চারুকলা। 

নোবেল জয়ী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর বই, 'আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান'-এ দেখিয়েছেন যে, আকবরের বিভিন্ন ধর্মের প্রতি আগ্রহ কীভাবে তাঁকে বিভিন্ন ধর্মের ক্যালেন্ডারের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। এত রকম ক্যালেন্ডারের ভিড়ে তিনি চেয়েছিলেন একটা এমন ক্যালেন্ডার, যা হবে সহজ, আধুনিক এবং আক্ষরিক অর্থেই সকলের। 

আরও পড়ুন
হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির নববর্ষ, ইতিহাস জানায় সে-কথাই

সময়টা আকবরের নিজের প্রবর্তিত ধর্ম ‘দীন-ই-ইলাহি’র রূপ পাওয়ার সময়ও বটে। তাই যে 'সম্মিলিত ক্যালেন্ডার' গঠনের চেষ্টা করছিলেন আকবর, তা ‘সকলের ধর্ম’ দীন-ই-ইলাহী প্রবর্তনের আগ্রহের সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে দাঁড়ায়। ক্যালেন্ডারটির নাম দেওয়া হল, 'তারিক-ই-ইলাহী', অর্থাৎ ‘ঈশ্বরের তারিখ’। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে চালু হয়ে গেল মুঘল সম্রাট প্রবর্তিত এই নতুন ক্যালেন্ডার। 

যদিও কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, এই উদ্দেশ্য নেহাতই সরল ছিল না। আগে থেকে প্রচলিত ক্যালেন্ডার সম্রাট আকবর সংশোধন করেছিলেন মূলত কর আদায়ের উদ্দেশ্যে। ঐতিহাসিকদের মতে, মুঘল সাম্রাজ্যে এর আগে যে ইসলামিক হিজরি ক্যালেন্ডার ব্যবহার হত, সেটা কখনোই সৌর কৃষিচক্রের সঙ্গে মিলমিশ খায়নি। তখন শস্য কাটার সময় অনুযায়ী ‘ফসল-ই-শান’ নামে একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়। এবং বাংলা ক্যালেন্ডারের আবির্ভাব তিথি হিসেবে ধরে নেওয়া হয় এটাকেই। 

আরও পড়ুন
বাঙালির সাহেবি নববর্ষের আদিখ্যেতা ও অন্যান্য

'বাঙালির ঐতিহাসিক অভিধান' (হিস্টোরিক্যাল ডিকশনারি অফ বেঙ্গলিজ) নামের গ্রন্থে লেখক কুনাল চক্রবর্তী এবং শুভ্র চক্রবর্তী আলোচনা করেছেন যে, এর আগে ইসলামী হিজরি পঞ্জিকা অনুসরণ করে ভূমি রাজস্ব আদায় করতে সমস্যা হচ্ছিল। বারবার সেই সমস্যার কথা পৌঁছচ্ছিল দিল্লিতে মুঘল দরবারে। মূলত চান্দ্রমাস ধরে চলে বলে, ইসলামিক ক্যালেন্ডারটি বাংলা ঋতুর সঙ্গে মিলতে পারেনি। 

ইসলাম ধর্মের বাণীবাহক মুহাম্মদ ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনা চলে যান। মুহাম্মদের এই জন্মভূমি ত্যাগ করার ঘটনা ইসলামে 'হিজরত' নামে পরিচিত। নবি মুহম্মদের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যেই সূচনা হয় হিজরি সাল গণনার। 

আরও পড়ুন
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নিজস্ব নববর্ষ ও বিচিত্র সব রেওয়াজ

এবং সেখানেই নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে চমকিয়ে দিয়েছিলেন সম্রাট একবার। তাঁর রাজ জ্যোতির্বিদকে একটি নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করতে বলেছিলেন তিনি। এতদিন অবধি বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরি হয়ে এসেছে সংস্কৃত জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’র উপর ভিত্তি করে। নতুন ক্যালেন্ডারে মিশে গেল ইসলামি ক্যালেন্ডার, সূর্য সিদ্ধান্ত এবং আকবরের রাজত্বের তারিখ। 

নতুন ক্যালেন্ডারটি তৈরি করা হয়েছিল কিছুটা জটিল পদ্ধতিতে। সহজ করে বললে, বাংলা ক্যালেন্ডার কীভাবে তৈরি হয়েছিল, তা একটা সূত্রের মাধ্যমে দেখানো যেতে পারে। 

সূত্র অনুযায়ী, বর্তমান বাংলা বছর = ইসলামী ক্যালেন্ডারমতে আকবরের রাজত্ব লাভের বছর (৯৬৩) + বর্তমান গ্রেগরিয়ান সৌর বছর (২০২১) - আকবরের মুকুট লাভের গ্রেগরিয়ান সৌর বছর (১৫৫৬)

এই সূত্র মেনে সহজ যোগ-বিয়োগ করলেই পাওয়া যাবে বর্তমান বাংলা বছর, অর্থাৎ, ১৪২৮। 

‘তারিক-ই-ইলাহী’ প্রবর্তিত হয়েছিল পুরো মুঘল সাম্রাজ্যের জন্যই। যদিও ‘দীন-ই-ইলাহি’র মতো এটিও আকবরের জীবদ্দশার পরে খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কিন্তু এর একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে থেকে গিয়েছিল বাংলা, যেখানে এটি কৃষির পাশাপাশি হিন্দু ধর্ম— উভয়েরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। 

সুতরাং, এটা ভাবলেই কী আশ্চর্য লাগে যে, রাম নবমী হোক বা দুর্গাপুজো, ক্যালেন্ডার দেখে দিন খুঁজতে গেলেই তাতে মিশে যাবে নবী মোহাম্মদের চলাচল থেকে প্রাচীন বৈদিক সূর্য সিদ্ধান্তের দর্শন। শুধুমাত্র ক্যালেন্ডারই যে ধর্ম সমন্বয়ের এত বড়ো উদাহরণ হয়ে থেকে যাবে, তাই বা কবে ভাবা গিয়েছিল!

Powered by Froala Editor

More From Author See More