প্রকাণ্ড দেওয়ালের ওপর হস্তাক্ষরে লেখা অজস্র বাক্য। অবশ্য সেগুলি যে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় লেখা— তা সহজেই অনুমান করা যায় বর্ণমালা কিংবা হরফের ব্যবহার দেখে। তবে অজানা অজস্র ভাষার ভিড়ে নজর কাড়বে একটি বাংলা বাক্যও— ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। ব্যাপার কী? বিদেশের মাটিতে কে বাংলা খোদাই করে এল পাথরের দেওয়ালে?
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস (Paris)। শিল্পের পাশাপাশি, প্যারিসকে ধরে নেওয়া হয় রোম্যান্সের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবেও। সেই রোম্যান্সের শহরে অবস্থিত মন্টমার্ত্রে আবেসেস উদ্যানেই রয়েছে এই আশ্চর্য দেওয়াল। যা পরিচিত ‘লে মুর দেস জে টা’ইমে’ নামে। যার অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘দ্য ওয়াল অফ আই লাভ ইউ’স’ (The Wall Of I Love You's) বা ‘ভালোবাসার প্রাচীর’। কিন্তু এমন অদ্ভুত নামকরণের কারণ কী?
আসলে মন্টমার্ত্রে আবেসেসের কেন্দ্রে অবস্থিত এই প্রাচীরে লিখিত রয়েছে কেবলমাত্র একটি বাক্যই। আর তা হল ‘আই লাভ ইউ’ বা ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। ৪০ বর্গ মিটারের এই দেওয়ালে সবমিলিয়ে এই বাক্যাংশটি লেখা আছে প্রায় ৩০০ শতাধিক ভাষায়। তাছাড়াও রয়েছে বহু উপভাষায় এই বাক্যের বিবরণ। সবমিলিয়ে সেখানে ‘আই লাভ ইউ’ খোদাই করা হয়েছে সহস্রাধিকবার।
আশ্চর্য এই প্রাচীরের নেপথ্যে রয়েছেন ফরাসি শিল্পী ফ্রেডরিক ব্যারন। তাছাড়াও পরবর্তীতে এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন আরেক ফরাসি শিল্পী ক্লেয়ার কিটো। তবে প্রাথমিকভাবে এমন কোনো সৌধ নির্মাণের কোনো পরিকল্পনাই ছিল না ফ্রেডরিকের। বরং, তিনি আদ্যোপান্ত আমুদে মানুষ, সংগ্রাহক। কারোর কারোর ভাষায় ‘পাগল’-ও বটে। স্কুলের দেওয়ালে বা টেবিলে পেন বা কম্পাস দিয়ে ভালোবাসার চিহ্ন খোদাই করতে দেখা যায় দামাল কিশোর-কিশোরীদের। সেভাবেই পথ চলা শুরু হয়েছিল ফ্রেডরিকের। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় ‘আই লাভ ইউ’ বাক্যাংশটি সংগ্রহ করা এক প্রকার নেশা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর কাছে।
প্রাথমিকভাবে পাড়া-প্রতিবেশীদের থেকেই বিভিন্ন ভাষায় লেখা ‘আই লাভ ইউ’ বাক্যটি সংগ্রহ করতেন ফ্রেডরিক। পরবর্তীতে প্যারিস নগরীতে ঘুরতে আসা ভিন দেশের পর্যটকদের কাছেও দ্বারস্থ হন তিনি। এতে শুধু ভিন্ন ভিন্ন ভাষাতে এই বাক্যটি বলতেই শেখেননি ফ্রেডরিক, বরং নিজের নোটবুকে স্বহস্তে তা লিপিবদ্ধও করেন তিনি। এমনকি নিজের এই সংগ্রহকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে ফরাসি ক্যালাগ্রাফার ক্লেয়ার কিটোর কাছেও দ্বারস্থ হন।
এভাবেই ক্লিটো জড়িয়ে পড়েছিলেন ‘ভালোবাসার প্রাচীর’-এর সঙ্গে। এমনকি এই দেওয়াল তৈরির পরিকল্পনা মূলত তাঁরই। ফ্রেডরিকের এই কর্মযজ্ঞে মুগ্ধ হয়েই মন্টমার্ত্রে আবেসেসে এই দেওয়াল তৈরির প্রস্তাব দেন তিনি। এই কর্মকাণ্ডে সামিল হন আরও এক ফরাসি শিল্পী ড্যানিয়েল বেলোগ। প্যারিসের উদ্যানে গড়ে তোলা হয় ৪০ বর্গ মিটারের প্রকাণ্ড প্রাচীরটি। ২১ বাই ২৯.৭ সেন্টিমিটারের এনামেল লাভার টাইলস দিয়েই তৈরি এই প্রকাণ্ড প্রাচীর। উল্লেখ্য, ফ্রেডরিকের ‘আই লাভ ইউ’ সংগ্রহের নোটবুকের পাতার আকারকে মাথায় রেখেই নির্ধারিত করা হয়েছিল এই আয়তনটি।
তবে মজার বিষয় হল, নিজে ক্যালিগ্রাফার হয়েও ‘ভালোবাসার প্রাচীর’-এ বাক্য লেখার সময় বিভিন্ন ভাষায় ক্যালিগ্রাফি করেননি ক্লিটো। বরং, ঠিক যেভাবে নিজের ডায়েরিতে বিভিন্ন ভাষায় ‘আই লাভ ইউ’ লিপিবদ্ধ করেছিলেন ফ্রেডরিক, হুবহু সেটাই খোদ করেন পাথরের দেওয়ালে।
২০০০ সালে যখন এই প্রাচীর তৈরি হয়েছিল তখন সেখানে সবমিলিয়ে প্রদর্শিত হত ২৫০টি ভাষায় লেখা ভালোবাসার বার্তা। বর্তমানে সেই সংখ্যাটা ছাড়িয়ে ৩০০-র গণ্ডি। বলার অপেক্ষা থাকে না আজও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অবলুপ্ত ভাষাদের তুলে আনার অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ফ্রেডরিক। বিশ্বাস, একমাত্র ভালোবাসাই জুড়ে রাখতে পারে গোটা দুনিয়াকে। সরিয়ে রাখতে পারে বিভেদ, বিচ্ছিন্নতা, হিংসাকে। তারই অন্যতম প্রতীক হিসাবে আজ প্যারিসের বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে রয়েছে ‘ভালোবাসার প্রাচীর’।
Powered by Froala Editor