চোখে-মুখে অসুস্থতার ছাপ। হারিয়েছেন চলচ্ছক্তিও। কথা বলতেও সমস্যা হচ্ছে বেশ। তবুও মঞ্চে বসে এক নিঃশ্বাসে তিনি বলে চলেছেন রূপকথার গল্প। ভারতীয় ফুটবলের রূপকথা। তাঁর কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ষাটের দশকে মোহনবাগানের ডুরান্ড জয়ের হ্যাটট্রিক, সাত জন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ইন্দর সিং-এর বিশ্বমানের গোল, পিকে-চুনি-বদরুদের দাপটের আখ্যান। এসব আখ্যানকে দুর্লভ বললেও বোধ হয় কম বলা হয়। কারণ, তৎকালীন প্রকাশিত সংবাদপত্র এবং তাঁর স্মৃতি ছাড়া আর কোথাওই নথিভুক্ত নেই সারা ভূভারতে।
হ্যাঁ, কথা হচ্ছে প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক তথা ধারাভাষ্যকার নভি কাপাডিয়াকে (Novy Kapadia) নিয়েই। বছর দুয়েক আগেও চরম অসুস্থতার মধ্যে দিল্লির এক সংবর্ধনা সভায় দর্শকদের এভাবেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মুগ্ধ করেছিলেন নভি কাপাডিয়া। এবার পৃথিবী ছেড়ে অন্য ভুবনে পাড়ি দিলেন তিনি। ফুটবল মাদকতা, ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের স্মৃতিচারণায় মন্ত্রমুগ্ধ হওয়ার সুযোগটাই হারালেন ফুটবলপ্রেমীরা। কলকাতা ডার্বির টানটান উত্তেজনার ম্যাচেও আর শুনতে পাওয়া যাবে না তাঁর কণ্ঠস্বর। সদাহাস্যকর ভঙ্গিতে ফ্রেম বাই ফ্রেম ম্যাচের বিশ্লেষণ করতেও আর দেখা যাবে না তাঁকে।
দীর্ঘদিন ধরেই দুরারোগ্য মোটর নিউরোন রোগে ভুগছিলেন ‘ভারতীয় ফুটবলের কণ্ঠস্বর’ (Voice Of Indian Football)। সাহায্য ছাড়া হাঁটাচলা করাও দুরূহ হয়ে উঠেছিল তাঁর পক্ষে। বিগত কয়েক বছর কেটেছে শয্যাশায়ী অবস্থাতেই। মাস খানেক আগে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায়, তাঁকে রাখা হয়েছিল ভেন্টিলেটর সাপোর্টে। শেষ পর্যন্ত জীবনযুদ্ধে যেন হার স্বীকার করে নিলেন ভারতীয় ফুটবলের কণ্ঠস্বর। বিদায় নিলেন মাত্র ৬৮ বছর বয়সে।
দিল্লির কাশ্মীরি গেটে এক পার্সি পরিবারে বড়ে ওঠা কাপাডিয়ার। সেখান থেকে মাইল দশেক দূরেই কনৌট প্লেস। আজকের রাজীব চক। ফুটবল রূপকথার চলমান এনসাইক্লোপিডিয়ার যাত্রাপথটা শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই। ফুটবলের মরশুমে সেই কনৌট প্লেস হয়ে উঠত স্বয়ং পীঠস্থান। ডুরান্ড কাপের আয়োজন হয়েছে। কনৌটের কাকেদা হোটেলে সেসময় ঢুঁ মারতেন চুনি, পিকে, অমল, আকবর, শ্যাম থাপা, জারনেইল সিং। ফুটবল মহারথীদের এই সমাহার দেখতে মানুষের ঢল নামত দিল্লির বুকে। সেই ভিড়েই হাজির থাকতেন কিশোর কাপাডিয়া। ফুটবলের নেশাও সেই ডুরান্ড কাপ থেকে। বাঙালি না হয়েও নিজে ছিলেন মোহনবাগানের অন্ধভক্ত।
আরও পড়ুন
দেশের প্রথম এলজিবিটিকিউ ফুটবল দল, নেপথ্যে মণিপুরের সাদাম
ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা এবং পরবর্তীকালে অধ্যাপনার জগতে ঢুকে পড়লেও তেকাঠির সঙ্গে সেই সম্পর্কে ছেদ পড়েনি কোনোদিনই। ফুটবল চর্চা নয়, বরং বলা ভালো দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ফুটবলের উপাসনা করে গেছেন তিনি। অক্লান্তভাবে ভারতীয় ফুটবলকে উপস্থাপন করে গেছেন ফুটবলপ্রেমী দর্শকমহলের কাছে।
আরও পড়ুন
তারকাখচিত জীবন ছেড়ে কৃষিকাজ, অনাহারের বিরুদ্ধে লড়ছেন এই ফুটবলার
শুধুই কি ফুটবল? যে-কোনো খেলার প্রসঙ্গ উঠলেই স্বচ্ছন্দে অগাধ পাণ্ডিত্যের ঝুলি খুলে বসতে পারতেন কাপাডিয়া। উড়াড় করে দিতে পারতেন অলিখিত ইতিহাস। আইলিগ, ডুরান্ড কাপ, ফেডারেশন কাপের পাশাপাশি সমানভাবে হকির ধারাভাষ্যেও তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন দীর্ঘদিন। সবমিলিয়ে সাক্ষী থেকেছেন ৯টি ফিফা বিশ্বকাপের। ভারতীয় সাংবাদিক হিসাবে তুলে এনেছেন আন্তর্জাতিক ফুটবল রূপকথাদের গল্প। ফুটিয়ে তুলেছেন সংবাদপত্রের পাতায়। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস সংরক্ষণে যেখানে আজও নিরুত্তাপ ফেডারেশন, সেখানে দাঁড়িয়ে তাঁর লেখা বই ‘বেয়ারফুট টু বুটস’ কিংবা ‘ফুটবল ফ্যানাটিকস এসেনসিয়াল গাইড বুক’-এর বিকল্প নেই এখনও।
আরও পড়ুন
ফুটবলের ‘কবীর খান’: আদিবাসী মেয়েদের খেলা শিখিয়েই হারানো স্বপ্নের খোঁজ কোচের
অথচ, এমন একজন ব্যক্তিত্বকেই শেষ বয়সে সম্মুখীন হতে হয়েছে চরম আর্থিক সমস্যার। ব্যয়বহুল চিকিৎসা, তার ওপর চার দশক অধ্যাপনার পরেও দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল তাঁর পেনশন। বাড়িতে টেলিভিশনের সংযোগটুকুও হারিয়েছিলেন অর্থের অভাবে। ছটফট করতেন খেলা দেখার জন্য। না, সেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি ফুটবল ফেডারেশন, সরকারও। পাশে ছিল না পরিবারও। দিল্লির বাড়িতে তাঁর সঙ্গী বলতে ছিল কেবলমাত্র একজন সুরক্ষাকর্মী এবং একজন পরিচারিকা। আদৌ কি যোগ্য সম্মানটুকু পেলেন ভারতীয় ফুটবলের বাল্মীকি?
Powered by Froala Editor