“একজন বাঙালি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, তাঁর ইতিহাস এবং সংস্কৃতি তাঁকে বাকিদের থেকে পৃথক করে রাখে। আজ সারা পৃথিবীতে বাঙালিরা ছড়িয়ে পড়েছেন নিজেদের গুণেই। আর সর্বত্রই সৃজনশীল, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী জাতি হিসাবে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত।” বলছিলেন শুভেন্দু মাইতি। তবে তাঁর মতে, “আজকের বিশ্বায়িত পৃথিবীতে প্রত্যেক জাতিই নিজেদের মূল থেকে সরে যাচ্ছে। তাই বাঙালি সংস্কৃতিও আজ গভীর সংকটের মুখোমুখি। এই সংকট পেরিয়ে যেতে হবে সকলকে হাতে হাত রেখেই।” আর সেই উদ্দেশ্যেই বোলপুর শহরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের অদূরে তিনি তৈরি করতে চলেছেন আরেকটি তপোবন। যার নাম ‘পান্থপাদপ’।
কী এই ‘পান্থপাদপ’? আসলে ১৬ বিঘা জমির উপর তৈরি শুভেন্দু মাইতির এক স্বপ্নের নাম ‘পান্থপাদপ’। ৭৬ বছরের জীবনে তিনি কম স্বপ্ন দেখেননি। বাংলার সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে তিনি তৈরি করেছেন একের পর এক সাংস্কৃতিক সংগঠন। তবে ‘পান্থপাদপ’ তাদের সবার থেকে আলাদা। বলা যায়, সব থেকে কঠিন একটি স্বপ্ন। কাঁটাতারের দুপারের বাঙালিদের তো বটেই, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের এক সুতোয় বেঁধে তোলার স্বপ্নের নাম ‘পান্থপাদপ’। তাঁর কথায়, “এই মাটিতে কাঁটাতারের বেড়া আমাদের আলাদা করে রেখেছে। আকাশেও পর্যাপ্ত জায়গা নেই। বাঙালিদের এক জায়গায় মিলিত হওয়া সম্ভব মহাকাশেই।” আর তাই সমস্ত বাঙালিদের যুক্ত করতে তিনি গড়ে তুলেছেন একটি ওয়েব পোর্টাল। আর তার পাশাপাশিই শান্তিনিকেতনের অদূরে গড়ে তুলতে চলেছেন ২৫টি কটেজ।
বাইরে থেকে দেখতে স্থানীয় আদিবাসীদের কুটির। প্রকৃতিকে কোনোভাবে বিরক্ত না করেই গড়ে উঠবে এই কটেজগুলি। অথচ তার মধ্যেই থাকবে সমস্ত ধরণের আধুনিক পরিষেবা। থাকা-খাওয়ার সু-বন্দোবস্তের পাশাপাশি থাকবে একটি স্টুডিও, একটি মুক্তমঞ্চ। সেখানে নিয়মিত বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা বহাল থাকবে। শুভেন্দুবাবু বলছিলেন, “প্রত্যেক বাঙালিই তাঁর জীবদ্দশায় একবার না একবার তো এই তীর্থক্ষেত্রে আসেন। তাঁদের সঙ্গে বাকিদের যুক্ত করে তুলতে পারলেই একটা জাতির নিজস্ব সত্তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।” শিশুদের মনের মধ্যে বাঙালিয়ানাকে উস্কে দিতে থাকছে একটি বিশেষ পার্ক। আর এই গোটাটার নির্মাণ এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবেন শিল্পী রূপচাঁদ কুণ্ডু।
এছাড়াও এই ১৬ বিঘা জমির মধ্যেই থাকছে প্রয়াত প্রত্নসংগ্রাহক সুশীল কুমার চট্টোপাধ্যায় ওরফে নকুবাবুর বিরাট সংগ্রহের একটি প্রদর্শশালা। তার মধ্যে বাঙালির নবজাগরণ পর্ব থেকে আজ অবধি নানা ইতিহাসের সাক্ষ্য তো রয়েছেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শুভেন্দু মাইতির ব্যক্তিগত সংগ্রহের একটি গ্রামোফোন কালেকশন। এছাড়াও থাকছে একটি পুতুলবাড়ি এবং লোকসংকৃতির একটি জাদুঘর। সেখানে ধামসা-মাদল থেকে শুরু করে নানা বাদ্যযন্ত্রের বিবর্তনকে ধরে রাখা হবে নিপুণভাবে। “আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত লোকসংস্কৃতির উপর কোনো সংগ্রহশালা তৈরি হয়নি। অথচ এখানেই তো আমাদের শিকড় নিমজ্জিত।” বলছিলেন শুভেন্দু মাইতি। আসলে বারবার বাঙালিকে তাঁর ইতিহাস মনে পড়িয়ে দিতে চান শুভেন্দুবাবু। তিনি বলেন, “সপ্তাহে একদিন অন্তত নিজস্ব খাবার খাওয়া এবং বাড়িতে বাংলা ভাষায় কথা বলার রেওয়াজটুকু চলুক সারা পৃথিবীতে।” কাজটা সহজ নয়। কিন্তু অসম্ভবও নয়, মনে করেন শুভেন্দুবাবু। আর সমস্ত মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে জল-হাওয়া পেয়ে ঠিকই মহীরুহে পরিণত হবে ‘পান্থপাদপ’।
আরও পড়ুন
মানুষের মতোই সংস্কৃতি বদলায় পাখিদেরও, জানাচ্ছে সাম্প্রতিক গবেষণা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
আকবরের হাত ধরেই জন্ম বাংলা ক্যালেন্ডারের, হয়ে উঠল বাংলা সংস্কৃতির অঙ্গ