গোলপার্ক থেকে গড়িয়াহাটের দিকে যেতে রাস্তার ডানদিকের ফুটপাথ ধরে হাঁটছেন আপনি। চোখে পড়বে এক সার বইয়ের দোকান। থরে থরে সাজানো পুরনো বই। মনে হতে পারে, কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইবাজারের ক্ষুদ্র সংস্করণ যেন। এই ছোট্ট বইবাজারের প্রথম গলিতেই তাঁর দোকান বাঁ হাতে।
তাঁর বলতে কথা হচ্ছে তাপস কয়ালের সম্পর্কে। বই-পোকাদের অধিকাংশের কাছেই তিনি পরিচিত ‘তাপসদা’ হিসাবে। দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বইয়ের ব্যবসা করে যাচ্ছেন গড়িয়াহাটের এই ফুটপাথে। অন্যান্য দোকানের থেকে তাঁর এই বই-ভাণ্ডার আলাদা করে বোঝার উপায় নেই তেমন। তবে দোকানের সামনে সামান্য দাঁড়িয়ে সাজানো বইয়ের মলাটগুলির ওপর চোখ বোলালেই হঠাৎ ঝটকা লাগতে পারে। কিংবা বহু খুঁজেও না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া বইয়ের নাম বললে হাসতে হাসতেই বার করে দিতে পারেন তিনি মিনিট খানিকের মধ্যেই। বলতে গেলে বইবাজারের ‘সিধুজ্যাঠা’ গড়িয়াহাটের তাপসবাবু।
“প্রায় চল্লিশ বছর হতে চলল এই দোকান চালাচ্ছি আমি। তবে তারও খান পঁচিশ বছর আগের দোকান। বাবা শুরু করেছিলেন এই ব্যবসা। সব মিলিয়ে দোকানের বয়স পঁয়ষট্টি বছরের মতো হবে। আমার বয়স তখন বারো কি তেরো বছর, বাবার সঙ্গে এসে কাজ করা শুরু করি এখানে।”
বলছিলেন তাপসবাবু। কথা বলার মাঝেই দোকানের ভিড় সামলাচ্ছেন তিনি। পাঠকদের খুঁজে দিচ্ছেন তাঁদের চাহিদার বই। কী নেই সেখানে? শেক্সপিয়ার, মিল্টন, অস্কার ওয়াইল্ড, চার্লস ডিকেন্সের মতো ক্লাসিক থেকে শুরু করে চেতন ভগত, নভোনীল, দুর্জয় দত্ত সবই রয়েছেন সেখানে। তবে থরে থরে সাজানো ইংরাজি বই দেখে বাংলা বইয়ের ভাঁড়ার নেই ধরে নিলে ভুল হবে মারাত্মক।
রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, শরতের সমগ্র তো বটেই; আধুনিক বাংলা বইও অনায়াসেই বের করে দেবেন তাপসবাবু। বিগত কয়েক দশক সংস্করণ না হওয়া কোনো দুষ্প্রাপ্য বই চাই? তাও রয়েছে তাপসবাবুর সংগ্রহে। রয়েছে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া, বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকাদের বিভিন্ন জানা-অজানা চমকপ্রদ সংখ্যা। যা হয়তো ধরে রেখেছে বাংলা লিটল ম্যাগাজিক আন্দোলনের ইতিহাসকে। যা দু’মলাটের মধ্যে ধরা রয়েছে অসাধারণ কোনো ডকুমেন্টেশন।
আরও পড়ুন
বাতিল, ফেলে-দেওয়া বই নিয়েই তৈরি লাইব্রেরি; অভিনব উদ্যোগ তুরস্কের সাফাইকর্মীদের
“পুরনো বহু পত্রিকা তো বটেই, বিভিন্ন হারিয়ে যাওয়া কমিকেরও সন্ধান পাবেন এখানে। তাছাড়া পাঠ্যপুস্তক, বিভিন্ন কয়েন, ফটোগ্রাফির কালেকশনের বইও আছে আমার কাছে। বিভিন্ন পোস্টার, কয়েন, টাকা, ডাকটিকিটের ছবি-সহ তথ্য রয়েছে এইসব বইতে। বহু পুরনো বুকলেটেরও সংগ্রহ আছে আমার কাছে। যাঁরা জানেন এসবের দরকার পড়লে একবাক্যে আমার কাছেই এসে সন্ধান করেন তাঁরা”, জানালেন তাপসবাবু।
এক কথায় বলতে গেলে যেন ছোট্ট একটা স্ট্রিট-লাইব্রেরি। আক্ষরিক অর্থেই তাই। কারণ, শুধু বই কেনা নয়। চাইলে তাপসবাবুর থেকে বই নিয়ে গিয়ে পড়ে আবার ফিরিয়ে দিতে পারেন তাঁর কাছে। খোলা রয়েছে সেই রাস্তাও। পাঠকদের খিদে মেটাতে বই ভাড়াও দেন তিনি। তবে কার্ড করানো বা রিনিউ করার ঝক্কি নেই কোনো। জমা রাখতে হবে ১০০ টাকা। বই ফেরত দিলেই তিনি ফিরিয়ে দেবেন তা। প্রতি মাস পিছু শুধু বইয়ের জন্য দিতে হবে ৩০ টাকা করে। তাতে পাঠকে পড়ার খিদেও মিটল আর খরচও থাকল হাতের মুঠোর মধ্যেই। অভিনব এমন পন্থাতেই বিশ্বাসী তাপসবাবু।
আরও পড়ুন
যুদ্ধের বিপরীতে অস্ত্র বই! অরুণাচল সীমান্তে ছাত্রদের হাতেই জন্ম নিচ্ছে লাইব্রেরি
তবে সাধারণ বইয়ের বাইরে তাপসবাবুর দোকানে সবথেকে আকর্ষণের জায়গা হল রিসার্চমূলক বিভিন্ন গ্রন্থ। ডকুমেন্টারি। সে-ব্যাপারে কথা বলতে গিয়েই তাপসবাবুর স্মৃতিচারণায় উঠে এল, “নিমাই ভট্টাচার্য কিছুদিন আগেই চলে গেলেন। ওঁকে প্রচুর বই দিয়েছি আমি। এখান থেকেই এসে নিয়ে যেতেন কোনো বিষয়ে গবেষণার দরকার পড়লে। ওঁকে আমি গোল্ডেন বুক অফ টেগোর দিয়েছিলাম বছর খানেক আগে। রবীন্দ্রনাথের সই করা। তাছাড়াও বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর গবেষণা করছেন, এমন বহু ব্যক্তিত্বই প্রয়োজনীয় বইয়ের খোঁজ করেন আমার কাছে। মুর্শিদাবাদ, এমনকি দিল্লি থেকেও বইয়ের দরকার পড়লে যোগাযোগ করেন আমার সঙ্গে। সংগ্রহ করে রাখতে বলেন। পরে এসে নিয়ে যান।”
আশ্চর্য হচ্ছেন? হওয়ারই কথা! কলকাতার ফুটের ছোট্ট এই দোকান থেকে রাজধানী অবদি পাড়ি দিচ্ছে বই, তা শুনে তো বিস্ময় লাগবেই। কিন্তু কোথা থেকে আসে এইসব অমূল্য বইয়ের সংগ্রহ? খানিক হেসেই তাপসবাবু বললেন, “চল্লিশ বছর ধরে ব্যবসা করছি। তাই পরিচিতের অভাব নেই। যাঁরা আমার থেকে দীর্ঘদিন বই নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ শহর ছেড়ে চলে গেলে পুরনো বই বিক্রি করে দিয়ে যান আমার কাছে। তাছাড়াও তাঁদের থেকে আমার নম্বর পেলেও কেউ ফোন করে বলেন বই বিক্রির কথা। সময়মতো তাঁদের বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করে আনি সেসব।”
আরও পড়ুন
মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো বই! পৃথিবীতে এখনও টিকে এমন ১৮টি উদাহরণ
শুধু ব্যবসাই নয়। প্রত্যেক বইয়ের গুরুত্ব ঠিক কতটা সে-ব্যাপারে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল তাপসবাবু। সে বই সংগ্রহ করতে রাতে দোকান বন্ধ করে কখনো ছুটে যান বাঘাযতীন, কখনো উত্তর কলকাতার গলি-ঘুঁজিতে। এক অক্লান্ত পরিশ্রম যে জড়িয়ে রয়েছে এইসব বই সংগ্রহের পিছনে তার কতটুকুই বা খোঁজ রাখি আমরা?
তাপসবাবুর দোকানে গেলে একটা কথা মাথায় আসতে বাধ্য। তা হল এই বিপুল বই তিনি রাখেন কোথায়? ফুটের ওপর দোকানে এই পাহাড়প্রমাণ সংগ্রহ কি রাখা সম্ভব? রহস্যোন্মোচন করলেন তিনিই। আসলে তাপসবাবুরা তিন ভাই-ই জড়িয়ে রয়েছেন এই ব্যবসায়। দুই ভাই বই নিয়ে বসেন ফুটপাথের ওপরে। আর পাকা দোকানের দায়িত্ব সামলান তাঁর আরেক ভাই। গড়িয়াহাটেই সে-দোকান। তাপসবাবুর দোকানের উল্টোফুটেই। বি. কে. বুক ট্রেডার্স। সেখানেই বই রাখেন তিনি দোকান বন্ধ থাকলে। তবে খানিক দুঃখের সঙ্গেই জানালেন কলেজ স্ট্রিটের অন্যান্য গুমটির মতোই দোকান ছিল তাঁর। উন্নয়নের চাকাই বছর কুড়ি আগে পিষে দিয়ে গেছে তাঁকে। কিন্তু ফুটপাথ হলেও সারাদিনের ছেদ পড়েনি বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে। তাই খারাপ লাগলেও তা মেনে নিয়েছেন তিনি।
তবে মহামারীর আবহে বইপাগলদের আনাগোনা কমেছে অনেকটাই। সেই কথাই ফুটে উঠছিল তাপসবাবুর কথায়। লকডাউনে দোকানও বন্ধ রাখতে হয়েছিল অনেকদিন। “আমি তো কলকাতায় ভাড়া থাকি। আমার আসল বাড়ি সরসায়। লকডাউন ঘোষণার দিন বাড়ির অনুষ্ঠানে ওখানেই ছিলাম। আটকে পড়েছিলাম, ফিরতে পারিনি”, জানালেন তিনি। তবে লকডাউনের নির্দেশ খানিক নমনীয় হতেই বইয়ের টানে হাজির হয়েছিলেন কলকাতায়। আবার দোকানে বসে পড়া টুল নিয়ে। সাজিয়ে ফেলা বই। তবে ইদানীং ইংরাজি বই পড়ার প্রবণতাই বাড়ছে মানুষের মধ্যে, তেমনটাই টের পাচ্ছেন তিনি। সেই সঙ্গে অনলাইন বই কেনার সুবিধাও খানিকটা কোপ বসিয়েছে পাঠক সংখ্যায়।
এসবের পরেও দুষ্প্রাপ্য বই পেতে গেলে ছুটে যেতে হবে তাঁর কাছেই। এই ক্ষেত্রে এখনও কোনো বিকল্পই নেই যে ইন্টারনেটের কাছে। তেমন বিকল্প আসা সম্ভবও না অদূর ভবিষ্যতে। জাঁক-জমক হয়তো নেই। নেই আতিশয্যও। যা রয়েছে, তা হল কম পাওয়ার এলইডি বাল্বের আলোর তলায় পাতলা ধুলোর আস্তরণ মাখা বইয়ের খনি। যার আলোকিত করার ক্ষমতা অপরিসীম। সে রোশনাই ছুঁতে গেলে চোখ বন্ধ করে এগিয়ে গেলে চলবে না এ-পথ দিয়ে। থমকাতে হবে খানিকটা। ছাই উড়িয়ে খুঁজতে হবে অমূল্য রতন...
Powered by Froala Editor