সিনেমার প্রযোজক প্রত্যেকেই; অর্থনৈতিক সংকটেও আশা হারাননি আড়ংঘাটার গ্রামবাসীরা

“গ্রামের ছেলে উজ্জ্বল। এসে যখন বলল গ্রামের সবাই মিলে একটা সিনেমা তৈরি হবে, তখন আমরা আর আগুপিছু ভাবিনি। আমাদের গ্রামকে নিয়ে সিনেমা, আমাদেরই ছেলেমেয়েরা অভিনয় করবে, তার দায়িত্বও আমাদেরই নিতে হবে।” বলছিলেন রাজীব মজুমদার। আড়ংঘাটা গ্রামের তিনি একজন বাসিন্দা। কিন্তু এখন তাঁর পরিচয় তার থেকেও বড়ো। তিনি আস্ত একটা সিনেমার সহ-প্রযোজক। গ্রামের প্রতিটা মানুষই একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন যে সিনেমা।

পরিচালক উজ্জ্বল বসুর সিনেমা ‘দুধপিঠের গাছ’। বাজেট খুব বেশি নয়। কিন্তু তার থেকেও অবাক করা এই অর্থ সংগ্রহের কাহিনি। কীভাবে জোগাড় হল টাকা? প্রসেনজিৎ রায় বললেন তাঁর নিজের কথা। “উজ্জ্বল যখন এসে বলল একটা সিনেমা বানাবে আমাদের নিয়ে, তখন আমি একটা ব্যাঙ্কের বই করিয়েছি। খানিকটা টাকা রেখেছিলাম তাতে। সেইটা নিয়ে এসে দিয়ে দিলাম উজ্জ্বলের হাতে। সিনেমা বানাতে গেলে টাকা তো লাগবেই।” এভাবেই জোগাড় হয়েছে ২৫ লক্ষ টাকা। গ্রামবাসীরা প্রত্যেকে নিজেদের সাধ্যমতো দিয়েছেন সেখানে।

‘দুধ পিঠের গাছ’ সিনেমার প্রযোজক গোটা আড়ংঘাটা গ্রামটাই। “আমরা যারা টাকা দিতে পেরেছি, শুধু তাদের কথা বললেই কিন্তু ভুল হবে। সবাই মিলেই সিনেমাটার প্রযোজনা করেছে। কেউ হয়তো ভ্যানরিক্সা চালায়। সেটের সমস্ত জিনিস সেই নিয়ে গিয়েছে। কারোর চায়ের দোকান থেকে এসেছে সবার জন্য চা। যে যেভাবে পেরেছে, সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে সবাই।” বলছিলেন প্রযোজকদের আরেকজন, চঞ্চল কুমার মোদক।

এই গোটা গ্রামটাই তাকিয়ে ছিল ৩ এপ্রিলের দিকে। সব কিছু ঠিক থাকলে সেদিনই বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ করত ‘দুধপিঠের গাছ’। কিন্তু মহামারী করোনা পরিস্থিতি সব এলোমেলো করে দিল। অন্যান্য সিনেমার মতোই আটকে গেল এই সিনেমার মুক্তিও। কিন্তু এর পিছনে তো কোনো বড়ো প্রোডাকশন হাউসের বিনিয়োগ নেই। আছে সামান্য কিছু মানুষের ভালোবাসার দান। কখনও দুশ্চিন্তা হয়নি? মনে হয়নি সব টাকা জলে গেল? প্রশ্ন করতেই একবাক্যে না না করে ওঠেন সকলে। রাজীব মজুমদারের কথায়, “উজ্জ্বল ভেঙে পড়লেও আমরা সবসময় সাহস দিয়েছি। আমরা জানতাম একদিন ঠিক মুক্তি পাবে এই সিনেমা।”

অবশেষে প্রায় এসেই পড়ল সেই দিন। ২১ অক্টোবর, পুজোর ঠিক আগেই মুক্তি পেতে চলেছে ‘দুধপিঠের গাছ’। আড়ংঘাটার মানুষদের জন্য এ আরেক উৎসব। “সত্যিই খুব ভালো লাগছে। আমাদের কথা সারা বাংলার মানুষ জানতে পারবে বলে ভালো লাগছে। আর আমরা নিশ্চিত এই সিনেমা সবার ভালো লাগবে।” আশা চঞ্চলবাবুর।

তবে সেই এপ্রিল মাস থেকে এখনও পর্যন্ত কী অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করেছেন সাধারণ মানুষরা, সেকথা ভাবতে গেলে সত্যিই অবাক হতে হয়। অমল প্রামাণিক হেসে উত্তর দেন, “আমরাও ব্যবসা করি। ছোট ব্যবসা। কিন্তু এটুকু বুঝি ব্যবসা করতে গেলে লাভ-লোকসান আছেই।” নিজেদের জীবনের সমস্ত সঞ্চয় তুলে দিয়েও এভাবেই অবিচল থাকতে পারেন তাঁরা। মহামারী করোনা পরিস্থিতিতে আর্থিক অচলাবস্থা গ্রাস করেছে গোটা গ্রামকে। কারোর ব্যবসাই লাভের মুখ দেখেনি এই কয়েক মাস। আর দিনমজুর মানুষদের কথা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই কারোর মধ্যে। আরেক প্রযোজক প্রসেনজিৎ রায়ের কথায়, “আমরা তো জানতাম সিনেমা ঠিক বেরোবে। আর বেরোলে মানুষের ভালো লাগবেই।” 

একটা সিনেমা, একটা গ্রামের গল্প। সবাই মিলে গড়ে তোলা একটা উদ্যোগ। মাত্র কয়েকটা মাসের জন্য নয়, জীবনের সমস্তটা জুড়ে এই সিনেমার গল্পকে বয়ে বেড়াবেন আড়ংঘাটার মানুষ। আড়ংঘাটার এই সার্বজনীন উদ্যোগ নিশ্চই সমস্ত দর্শকের মন জয় করে নেবে।

Powered by Froala Editor