ধরুন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। এমন সময় আপনার সামনে হাজির আস্ত একটি বন্য চিতাবাঘ। রোদ্দুরে ঝিলিক দিচ্ছে তার দাঁত। বলার অপেক্ষা থাকে না, এমন পরিস্থিতিতে পড়লে মুহূর্তের জন্য হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবে যে-কারোর। তবে ভারতের বুকে রয়েছে এমন এক গ্রাম, যেখানের গ্রামবাসীরা প্রতিদিনই সাক্ষী হয় এমন দৃশ্যের। চিতাবাঘকে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, বরং পাত্রে করে দুধ খাওয়ান তাদের।
শুনতে একটু আশ্চর্য লাগাই স্বাভাবিক। রাজস্থানের (Rajasthan) পালি জেলা। রৌদ্রতপ্ত আরাবল্লীর মাঝে ছোট্ট একটি গ্রাম। নাম, বেরা। শতাব্দীপ্রাচীন এই গ্রামেই অবাধ স্বাধীনতায় পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায় চিতাবাঘেরা। এমনকি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গোটা বিশ্বের মধ্যে চিতাবাঘ বা লেপার্ডের (Leopard) সবচেয়ে বেশি জনঘনত্ব রয়েছে এই গ্রামেই। তবে চিতার জন্য বিখ্যাত নয় বেরা। বরং, বেরা গোটা বিশ্বের কাছে সুপরিচিত মানুষ ও চিতাবাঘের বিবাদহীন সহাবস্থানের জন্য। বলতে গেলে, এই গ্রামে তারা যেন মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। তাদের খানিক শ্রদ্ধার চোখেই দেখেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু হিংস্র চিতাবাঘের সঙ্গে কীভাবে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল এই গ্রামের মানুষদের?
সেই গল্পে যাওয়ার আগে কয়েকটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন। বেরার এই কাহিনি সর্বপ্রথম সামনে আসে আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে। নেপথ্যে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার প্রতাপ সিং (Pratap Singh)। সাড়ে চার দশক আগে প্রতাপ সিং এবং তাঁর স্ত্রী কাত্যায়নী নিছকই ঘুরতে গিয়েছিলেন এই গ্রামে। তবে মানুষ ও চিতাবাঘের সহাবস্থানের দৃশ্য দেখে রীতিমতো চমকে ওঠেন তাঁরা। তাঁদের ছবির হাত ধরেই যেমন পরিচিতি পায় এই গ্রাম। তেমন তাঁরাও স্থায়ী বসতি গেরে বসেন বেরায়। এমনকি তাঁদের হাত ধরেই ধীরে ধীরে পর্যটক আসতে শুরু করে এই গ্রামে। গ্রামের ঠিক বাইরে প্রথম রাত্রি আবাস বা হোটেল তৈরির নেপথ্যেও রয়েছেন প্রতাপ এবং তাঁর স্ত্রী। পরবর্তীতে তাঁর তোলা ছবি সহকারে বেরার কাহিনি নিয়ে আস্ত বই লেখেন সন্দীপ ভুতোরিয়ার।
এবার ফিরে আসা যাক মূল কাহিনিতে। বেরায় চিতাবাঘ ও মানুষের এই অপার্থিব বন্ধুত্বের নেপথ্যে রয়েছেন একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর মানুষরা। রাবারি সম্প্রদায়। আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে ইরান থেকে আফগানিস্তান ঘুরে ভারতে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন রাবারিরা। মূলত তাঁরা ছিলেন যাযাবর। এমনকি ‘রাবারি’ কথাটির অর্থও হল ‘বহিরাগত’। তবে ভিনদেশ থেকে এলেও, রাজস্থানের মাটিকেই আপন করে নিয়েছিলেন তাঁরা। আজও মরুভূমিতে কৃষিকাজ এবং পশুপালন করেই দিন কাটান রাবারিরা। এমনকি কালের আবহে তারা হয়ে উঠেছেন পশুপতি শিবের ভক্ত। চিতাবাঘের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সেই সূত্রেই।
অবশ্য চিতারাও যে এই গ্রামের আদি বাসিন্দা— তেমনটা নয় একেবারেই। বলতে গেলে তারাও রাবারিদের মতোই বহিরাগত। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুযায়ী শ-খানেক বছর আগে রাজস্থানের কুম্ভলগড় জাতীয় উদ্যান থেকে এই পাথুরে গ্রামে চলে এসেছিল গোটা ছয়েক চিতাবাঘ। বেরা-জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র গুহা এবং সুড়ঙ্গতে দিব্যি সংসার পেতে বসে তারা। ময়ূর, নীলগাই, হরিণ তো রয়েছেই, সেইসঙ্গে স্থানীয় মানুষদের পোষা গরু, ছাগল, মুরগি ইত্যাদি গবাদি পশু— সবমিলিয়ে শিকারেরও অভাব ছিল না কোনো। ফলে বেরায় দ্রুত বংশবিস্তার করতে থাকে চিতাবাঘরা।
পরিসংখ্যান ও নথি অনুযায়ী, বিশ্বের অন্যত্র প্রতি ৩টি চিতাবাঘের শাবকের মধ্যে কেবলমাত্র ১টি শাবকই বেঁচে থাকে শেষ পর্যন্ত। তবে বেরার হিসেব অনুযায়ী, সেখানে চিতা-শাবকের বেঁচে থাকার হার প্রায় ১০০ শতাংশ। ফলে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যেখানে মাত্র ৬টি বাঘ ছিল এই অঞ্চলে, ২০২০ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮০টির কাছাকাছি। বেরা হয়ে ওঠে চিতাবাঘের সবচেয়ে ঘন জনবসতিপূর্ণ একালা। মজার বিষয় হল, বেরায় এতকিছুর পরেও মানুষের সঙ্গে চিতাবাঘের বড়ো কোনো সংঘাত হয়নি আজ পর্যন্ত। কেবলমাত্র একটি শিশুকেই একবার জঙ্গলে টেনে নিয়ে গিয়েছিল চিতাবাঘ। তবে তাকেও প্রাণে মারেনি বা আহত করেনি। বলতে গেলে, শাবক অবস্থা থেকেই মানুষকে দেখে বড়ো হয়ে ওঠার জন্যই হয়তো, মানুষের প্রতি হিংস্র নয় বেরার চিতাবাঘেরা। ফলে, রাস্তা-ঘাটে তো বটেই, বাড়ির উঠোন এবং বিশেষ করে মন্দিরে হামেশাই দেখা যায় চিতাবাঘেদের। মন্দিরে তাদেরকে নিজে হাতে দুধ, জল খাওয়ান পুরোহিতরা। অন্যদিকে চিতাবাঘেরা গবাদি পশু শিকার করলেও, সে-নিয়ে চিন্তিত থাকেন না স্থানীয়রা। বিশ্বাস, মহাদেব নাকি এতে তাঁদের দ্বিগুণ সম্পদ ফিরিয়ে দেবেন। এমনকি সেখানে চিতাবাঘ পুজিত হয় ‘অম্বে মাতা’ নামের এক দেবী হিসাবে। সেই কারণেই হয়তো ‘চিতাবাঘের দেশ’ হিসাবে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত বেরা।
২০০৩ সালে বেরা সংলগ্ন জাওয়াই বাঁধের নিকটবর্তী ২০ বর্গকিলোমিটার জায়গাকে চিতাবাঘ সংরক্ষণ অঞ্চল বলে ঘোষণা ভারত সরকার। এই অঞ্চলেই গড়ে উঠেছে চিতা সাফারি। হিসেব বলছে, ৯৯ শতাংশ পর্যটকরাই সেখানে গিয়ে দেখা পেয়েছেন চিতাবাঘের। তাছাড়াও শেয়াল, হায়েনা, নীলগাই, কুমির এবং প্রায় প্রজাতির পাখি রয়েছে বেরা ও বেরা-সংলগ্ন অঞ্চলে। কী ভাবছেন, একবার ঢুঁ মেরে আসবেন নাকি এই গ্রামে? হলফ করে বলা যায়, একবার এই গ্রামে পা রাখলে মন ভালো হয়ে যাবে যে-কোনো প্রকৃতিপ্রেমীরই।
Powered by Froala Editor