ছোটোবেলায় একটা গালভরা শব্দ মুখস্থ করেছিলাম। ‘নিউমিসম্যাটোলজি'। নতুন-পুরাতন মুদ্রা সংগ্রহ বা তাই নিয়ে পড়াশোনাকে এই নামে ডাকা হয়। ঠাকুমার মোষের শিং-দিয়ে বানানো একটা বাক্সে ছিল একরাশ পুরোনো ভারতীয় কয়েন। তাদের কোনোটা পঞ্চম জর্জের আমলের, কোনোটা আবার খোদ মহারানি ভিক্টোরিয়ার যুগের। যথারীতি সেই বাক্স সমেত মুদ্রারাশি পকেটস্থ করেছিলাম। বড়ো বাসনা ছিল, সংগ্রহ বাড়ানোর। শুধু দেশেই আটকে থাকব কেন? বিদেশি আত্মীয়দের কাছ থেকে যোগাড় করেছিলাম পাউন্ড আর ডলার। কিন্তু এইটুকুতেই সন্তষ্ট হওয়ার পাত্র আমি নই। বাবা বললেন, ‘কয়েন কিনতে পাওয়া যায়।’ সত্যি? ‘পুজো পাব্বুনি’ যা জমেছিল, তার সবটুকু নিয়ে মায়ের হাত ধরে একদিন বেরিয়ে পড়লাম।
পার্ক স্ট্রিট মোড় ধরে সোজা হেঁটে ডানহাতে রাসেল স্ট্রিট। লাল সাইনবোর্ডে সাদা অক্ষরে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘ইন্ডিয়া'স হবি সেন্টার’। ঢোকার মুখেই চমক। শোকেসে থরে থরে সাজানো খেলনা। দেশি বিদেশি মুদ্রা। ডাক-টিকিট। এরোপ্লেনের মডেল। স্ক্র্যাপ মেটালের গাড়ি। স্পাইডার ম্যান! এককথায় স্বর্গরাজ্যে পৌঁছে গিয়েছি। দোকানের একপাশে আইসক্রিম পার্লার। সেখানেও নানা ফ্লেভারের হাতছানি। হবি সেন্টার নামক দোকানটিতে সেই দিন থেকে আনাগোনা শুরু হল। জানতে পারলাম, কীভাবে মুদ্রা চিনতে হয়। তার যত্ন নিতে হয়। প্রতিদিন দুপুর বারোটা থেকে বিকেল তিনটে অবধি এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক দোকানে আসেন। নাম পণ্ডিতজি। তাঁর হাতেই মূলত ‘মানুষ’ হচ্ছিলাম। শুধুমাত্র মুদ্রাই না, ডাকটিকিট সংগ্রাহক হিসেবেও আমার হাতেখড়ি করিয়েছেন পণ্ডিতজি। নিঝুম দুপুরে বাসে চেপে পৌঁছে যেতাম জেনারেল পোস্ট অফিস। ফিলাটেলি বিভাগে সন্ধান করতাম, নতুন ডাকটিকিট বা ‘ফার্স্ট ডে কভারে’র…
মাধ্যমিকের পরে হারিয়ে গিয়েছিল স্ট্যাম্প এলবাম। ধুলো পড়ছিল মুদ্রার বাক্সে।
তবে পার্ক স্ট্রিট পাড়ায় কলেজ হওয়ার সুবাদে প্রায়ই দেখতে পেতাম লাল সাইনবোর্ড। আমার ‘সব-পেয়েছির দেশ'।
‘ইন্ডিয়াজ হবি সেন্টারে’র জন্ম স্বাধীনতার ঠিক একবছর পরে। কলকাতার সুরেশ কুমার বেড়াতে গিয়েছিলেন আমেরিকা। সেখানে চোখে পড়ে সুবৃহৎ খেলনার দোকান। তখন পশ্চিমবঙ্গ কেন, সারা ভারতেও এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের কথা কেউ ভাবতে পারেননি। খেলনার ব্যবসায় ঝুঁকি যথেষ্ট। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা নিয়েই ফেললেন সুরেশ। ১৯৪৮ সালে পার্ক স্ট্রিটের একটা ছোট্ট ঘরে বেশ কিছু এরোপ্লেনের মডেল নিয়ে বসে পড়লেন তিনি। আর ছিল বিদেশ থেকে আমদানি কিছু খেলনা। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠল ব্যবসা। এর ক'বছর পরেই রাসেল স্ট্রিটে প্রায় ৪৩০০ স্কোয়ার ফুট জায়গা নিয়ে জাঁকিয়ে বসল ইন্ডিয়াজ হবি সেন্টার। কচিকাঁচাদের কাছে সুরেশ ছিলেন ‘খুড়ো।’ দোকানের একপ্রান্তে পড়ে রাশি রাশি প্লেনের মডেল। সেটা ছিল আসলে সুরেশখুড়োর ল্যাবরেটরি। খোকাখুকুদের সেখানে প্লেন মডেলিং শেখাতেন তিনি। পাশাপাশি চলত স্ট্যাম্প আর কয়েন সংগ্রাহকদের নানা আবদার মেটানো…
‘তুমি কি পণ্ডিতজিকে খুঁজছ? হি ইজ নট হিয়ার।’
আরও পড়ুন
আধুনিকতার যুগে ব্রাত্য তারা, শতাব্দীপ্রাচীন স্মৃতি নিয়ে ধুঁকছে কলকাতার ‘সি ব্রস স্টুডিও’
পরিচিত গলা শুনে চমকে উঠলাম। আটবছর পরে আবার হবি সেন্টারে ঢুকতে গিয়ে নস্টালজিয়ায় এতটা ভেসে যাব, ভাবিনি। দেখলাম, প্রতিষ্ঠানের বর্তমান কর্ণধার সুরেশ-পুত্র ঋষি কুমার দাঁড়িয়ে।
আরও পড়ুন
বাতিল টায়ার দিয়ে তৈরি পার্ক, কলকাতার বুকেই একটুকরো মায়ানগরী
পণ্ডিতজি নাকি এখনো আসেন মাঝে মাঝে। দোকানঘর এখনো ধুলো-ধূসরিত। অগোছালো। ঋষি কুমার তাঁর প্রয়াত পিতার মতোই কচিকাঁচাদের কাছে ‘ঋষি খুড়ো’। ময়দানে সদ্য মডেল প্লেন উড়িয়ে দোকানে এসেছেন। সাদা জামায় ধুলোর ছোপ। নিজের পরিচয় দিলাম। ‘পুরোনো পাপী’কে চিনতে পেরে হেসে ফেললেন খুড়ো।
আরও পড়ুন
ছাতুবাবুর মাঠে যে খেলা দেখতে ভেঙে পড়ত সারা কলকাতা
‘দেখো! ঘুরে দেখো! আজকে ফাঁকা রয়েছে।’
আলো আঁধারির মধ্যে উঁকি মারে সুরেশ কুমারের অসমাপ্ত প্লেনের মডেল। স্ক্র্যাপ মেটালের গাড়ি সযত্নে হাতের তালুতে তুলে নিই আমি। ঋষি কুমার হাত রাখেন কাঁধে...
‘লিসন কিড! তোমাকে ভালোই মনে হচ্ছে। তুমি আমাদের নিয়ে বেশি কিছু লিখো না। এখানে প্রচুর লোক আসবে, সেলফি তুলবে। কেউ একটা কয়েন পর্যন্ত কিনবে না। ইনফ্যাক্ট, যারা কিনবেও, তারা সত্যিই কি ভালোবাসে কালেক্ট করতে... সব অনলাইন কেনে জানো…’
গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠছিল কষ্ট। সত্যিই তো! আমাজন-ফ্লিপকার্টের চক্করে হারিয়ে গিয়েছে দোকানে গিয়ে খেলনা নেড়ে চেড়ে দেখার মজা। লকডাউনে সেল হয়নি এক্কেবারে। কিন্তু তাই নিয়ে মোটেই ভাবিত নন ঋষি। এটা ‘তাঁর’ জায়গা। তিনি কাউকে ছাড়বেন না। ‘দিস প্লেস বিলংস টু মাই হার্ট। ব্যবসা যাই হোক, আই উইল নট থ্রো ইট এওয়ে…’
ঋষি খুড়োকে গুডবাই জানিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়াই। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজছে সাহেবপাড়া। বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে গাল বেয়ে দু'ফোঁটা গরম জলও যেন গড়িয়ে পড়ল বুকপকেটে…
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ঋষি কুমার, ‘ইন্ডিয়াজ হবি সেন্টার’
তথ্যসূত্র: ‘হেরিটেজ রিটেইলার্স অফ ক্যালকাটা (১৭৮৫-১৯৫০)', আশীষ সান্যাল
ছবি - অনিতেশ চক্রবর্তী
Powered by Froala Editor