দেশভাগের পর শরণার্থীদের পাশে বিমান কোম্পানি; নেপথ্যে কেরালার উদ্যোগপতি

সদ্য স্বাধীন হয়েছে দেশ। আর স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে এসেছে দেশভাগ। প্রতিদিন সীমান্ত পেরোচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। সম্ভবত বিশ শতকের সবচেয়ে বড়ো শরণার্থী মিছিলের সাক্ষী ছিল ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান। কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে আসা অসহায় মানুষদের প্রয়জনীয় পুনর্বাসনের ব্যবস্থাটুকু তো করতে হবে। এক জায়গায় বেশি মানুষের ভিড় সম্ভব নয়। যাতায়াতের এই পরিকাঠামো তৈরি হবে কীভাবে? প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ভাবছিলেন বিমানের কথা। কিন্তু তখন ভারতের সবচেয়ে বড়ো বিমান সংস্থাটি ব্রিটিশ মালিকানাধীন। এছাড়া রয়েছে কিছু বেসরকারি সংস্থা। ভারত সরকারের হাতে কোনো বিমানই নেই।

ঠিক এই সময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল জুপিটার এয়ারলাইন্স। দেশভাগের সমস্ত শরণার্থীদের যাতায়াতের জন্য বিনামূল্যে ব্যবহার করা যাবে তাঁদের বিমান। অবাক হয়েছিলেন নেহেরু। কোনো ব্যবসায়িক চুক্তি নয়, সরকারের কাছ থেকে কোনো সাহায্যের শর্তও নয় – নিছক মানবিকতার খাতিরেই এগিয়ে এল একটি কোম্পানি। সীমান্ত অঞ্চল থেকে দফায় দফায় শরণার্থীদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হতে থাকল দেশের নানা প্রান্তে। যে মানুষটিকে ছাড়া এই কাজটা সম্পূর্ণ হত না, তিনি ডঃ আলাগাপ্পা চেট্টিয়ার। ব্রিটিশ ভারতের উদ্যোগপতিদের মধ্যে অন্যতম। তবে ব্যবসায়িক দিকটি গৌণমাত্র। তাঁর সবচেয়ে বড়ো পরিচয়, তিনি একজন সমাজ সংগঠক। আজও তাঁর নাম মনে রেখেছে কেরালার কোচি শহরের নিকটবর্তী একটি গ্রাম। আলাগাপ্পা নগর। হ্যাঁ, আলাগাপ্পা চেট্টিয়ারের নামেই নাম এই গ্রামের। এখনও প্রতি বছর ৬ এপ্রিল চেট্টিয়ারের জন্মদিনে কেক কাটেন গ্রামবাসীরাই।

কোচি শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন চেট্টিয়ার। কোনোদিন কোনোকিছুর অভাব বোধ করেননি। ২০ বছর বয়সে প্রথম গ্রামে গিয়ে বুঝেছিলেন দেশের বাস্তব চেহারাটা। কিন্তু ততদিনে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ইংল্যান্ডে গিয়েই কিছুদিনের মধ্যে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হলেন চেট্টিয়ার। এমনিতেই তখন কুষ্ঠরোগীকে এড়িয়ে চলত সকলে। তার উপর চেট্টিয়ার একজন ভারতীয়। ইংল্যান্ডের মাটিতে অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। তবু পড়াশোনা চালিয়ে গেলেন তিনি। চেট্টিয়ার চেয়েছিলেন বৈদেশিক বিভাগে কাজ করতে। পরীক্ষায় পাশও করলেন। কিন্তু শারীরিক কারণে বাদ পড়ে গেলেন। এরপর ইংল্যান্ডে থেকেই আইন নিয়ে পড়াশোনা করলেন তিনি। বছর সাতেক ইংল্যান্ডে থেকে ফিরে এলেন ভারতে। কেরালা গ্রাম্য পরিবেশে।

একের পর এক ব্যবসা শুরু করলেন চেট্টিয়ার। অবশ্য তা মুনাফা অর্জনের জন্য নয়। তখন স্বদেশি আন্দোলনের নতুন পর্যায় শুরু হয়েছে। সেই স্রোতের থেকে খানিকটা দূরেই সরে ছিল দক্ষিণ ভারত। চেট্টিয়ার সেখানে শিল্পায়নের জোয়ার নিয়ে এলেন। কোচি শহরের কাছে কাপড়ের মিল তৈরি করলেন। এছাড়া বার্মায় বেশ কয়েকটা খনি কিনলেন। মুম্বাইতে হোটেল তৈরি করলেন। কলকাতায় তৈরি করলেন ইন্সিওরেন্স কোম্পানি। স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবসাতেও নামলেন। তবে ছোটো থেকেই ইচ্ছা ছিল আকাশে ওড়ার। পাইলটদের গল্প শুনে বড়ো হয়েছেন। ইংল্যান্ডে গিয়ে পাইলট লাইসেন্সও পেয়েছিলেন। সেই নেশার বসেই কিনে নিলেন একটি বিমান কোম্পানি। নাম দিলেন জুপিটার এয়ারলাইন্স। দেশভাগের সময় যে সংস্থা নিঃস্বার্থভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।

এই সময়েই একটি দুর্ঘটনায় কোম্পানির একটি বিমান নষ্ট হয়ে যায়। এদিকে ইন্সিওরেন্স কোম্পানি বিমার টাকা দিতে চায় না। কারণ সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, কেবলমাত্র যাত্রী পরিবহণের জন্য বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হবে এই বিমান। কিন্তু এক্ষেত্রে তো বিমান ব্যবহার করছিল সেনাবাহিনী। ডঃ চেট্টিয়ার কিন্তু ইন্সিওরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেননি, বিমার টাকার জন্য তদবিরও করেননি। বরং দ্রুত অন্য একটি বিমান পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য। স্বাধীনতার পর কেরালার গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্যও নানা পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি। তাঁর উদ্যোগেই তৈরি হয়েছে চেন্নাইয়ের আলাগাপ্পা কলেজ অফ টেকনোলজি। এমনকি গরিব শিশুদের স্কুলমুখী করার জন্য মিড-ডে মিলের পরিকল্পনাও প্রথম নিয়েছিলেন তিনি। একরকম তাঁর জোরাজুরিতেই প্রধানমন্ত্রী নেহেরু বাধ্য হয়েছিলেন কারাইকুড়ি শহরে সেন্ট্রাল ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট তৈরি করতে। গবেষণার জন্য যাবতীয় জমি এবং অর্থও দিয়েছিলেন তিনি। ডঃ আলাগাপ্পা চেট্টিয়ার ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমাজ সংগঠকদের মধ্যে জায়গা পেতে পারতেন। কিন্তু আজ হয়তো কেরালার একটি গ্রাম ছাড়া তাঁকে মনে রাখেনি কেউই।

Powered by Froala Editor

More From Author See More