জলে কুমির, ডাঙায় বাঘের দেশে সামান্য একজন শিক্ষক হিসেবে এসেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে সেখানকার জনগণের কাছেই হয়ে উঠেছিলেন আশ্রয়। দরিদ্র মানুষগুলোর যাবতীয় সুবিধা অসুবিধার খোঁজ রাখতেন তিনি। তাঁর চোখ দিয়েই সুন্দরবন পেয়েছিল উন্নয়নের ছোঁয়া। সেই তুষার কাঞ্জিলালই বুধবার প্রয়াত হলেন। সুন্দরবনের দ্বীপগুলোর বাসিন্দাদের নিয়ে তাঁর ভাবনা, তাঁর কাজ প্রশংসিত হয়েছিল নানা মহলে। পেয়েছিলেন পদ্মশ্রী পুরস্কারও। তবে তার থেকেও এগিয়ে তিনি পেয়েছিলেন এই দরিদ্র মানুষগুলোর ভালবাসা। অভিভাবককে হারিয়ে, তাই সুন্দরবন আজ বিমর্ষ…
১৯৬৭ সালে শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে তিনি প্রথমবার আসেন সুন্দরবনে। তবে কেবলমাত্র রাঙাবেলিয়া জুনিয়র হাইস্কুলের শিক্ষক হিসেবে আটকে থাকেননি তুষারবাবু। রাঙাবেলিয়ার মানুষদের অবস্থা তখন একদম ভালো ছিল না। ঘরে ঘরে দারিদ্র্য, শিক্ষা প্রবেশ করেনি অনেক জায়গাতেই। অনগ্রসর শ্রেণীর এই মানুষদের পাশেই দাঁড়ালেন অর্থনীতির এই স্নাতক শিক্ষক। ছোটো থেকেই মার্ক্সবাদের প্রতি আকর্ষণ। মানুষের জন্য কাজ করাকেই জীবনের অন্যতম পথ বলে মনে করে এসেছেন তুষারবাবু। শেষ পর্যন্ত সেটা করেও গেছেন।
মূলত তাঁরই উদ্যোগে ও উদ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট। সুন্দরবনের গ্রামে গ্রামে পানীয় জলের বন্দোবস্ত করেন। স্কুলে দুপুরে ছাত্রদের খাবারের দায়িত্বও নেন নিজে। পরবর্তীতে সুন্দরবনের উন্নয়নের জন্য জোরকদমে কাজ শুরু করেন। রীতিমতো সমীক্ষা করে তৈরি করেন মানুষদের মূল অসুবিধার তালিকা। সেই রিপোর্ট পরে যায় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। মূলত তারপরেই সমস্ত উন্নয়নমূলক কাজ শুরু হয়।
শুধু কি তাই? সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ জায়গায় নদী বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করেছেন। পুরো সুন্দরবনের উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। সেখানকার নারীদের স্বনির্ভর করার জন্য তৈরি করেছিলেন রাঙাবেলিয়া মহিলা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো-অপারেটিভ। আজ সুন্দরবনের রূপ আগের থেকে যা উন্নত হয়েছে, সবের পেছনেই তুষার কাঞ্জিলালের অবদান। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন সেখানকার রূপকার, অভিভাবক। নিজেও বলতেন, নোয়াখালি প্রথম জন্মভূমি হলে, রাঙাবেলিয়া দ্বিতীয়। চেয়েছিলেন, এখানেই যেন তাঁর অন্ত্যেষ্টি হয়। তাঁর শেষ ইচ্ছার মর্যাদা রাখা হয়েছে। শুধু পুঁথিগত নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী না থেকে, সরাসরি মাঠে নেমে কাজ করেছিলেন তুষার কাঞ্জিলাল। আর তার ফল সবাই ভোগ করছে। অভিভাবককে হারিয়ে আজ শোকস্তব্ধ সুন্দরবন, রাঙাবেলিয়া।