২০২০ সালের ২৬ মার্চ। প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী বব ডিলানের ইউটিউব চ্যানেলে পোস্ট করা হল প্রায় ১৭ মিনিটের দীর্ঘ একটি গান! গানের কথায় বলা হচ্ছে:
বেঁচে থাকার জন্য খুব ভালো একটা দিন
হঠাৎ কখন যেন মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসে
আচমকা কাউকে বলি হয়ে যেতে হয়!
একটা মুহূর্ত দাঁড়াও!
তোমরা চেনো? জানো তোমরা আমাকে?
অবশ্যই আমরা চিনি! জানি তুমি কে...
তারপরই তারা তার মাথা গুঁড়িয়ে দিল চলন্ত গাড়ির মধ্যে
যে ভদ্রলোকের ‘মৃত্যুর পরোয়ানা’ লেখার কথা হচ্ছে এখানে, তিনি প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। ১৯৬৬ সালের ২২ নভেম্বর আমেরিকার রাস্তায় যাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই হত্যার জট খোলা যায়নি এখনও। বরং এই ২০২০ সালে দাঁড়িয়েও প্রেসিডেন্ট কেনেডি হত্যার কারণ হিসেবে এখনও শোনা যায় নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের জল্পনাকল্পনা।
অনেক আমেরিকাবাসীই মনে করেন যে, প্রেসিডেন্ট কেনেডি হত্যার পিছনে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির হাত ছিল না। বরং তার থেকেও বড়ো ধরনের কোনও ষড়যন্ত্র ছিল সেটা। ফ্ল্যাশ ব্যাকে ফিরলে দেখা যাবে, টেক্সাসের ডালাস শহর। পথের দু’ধারে ভিড়। ভিড়ের কারণ, রাস্তার মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যাওয়া একটি ছাদ খোলা লিমুজিন গাড়ি। ছাদ খোলা লিমুজিন গাড়ির সওয়াড়ি টেক্সাসের গভর্নর জন কনালি, তাঁর স্ত্রী নেলি কনালি এবং সস্ত্রীক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। রাস্তার পাশে উঁচু উঁচু বাড়িগুলোতেও লোকজনের ভিড়। সবাই প্রেসিডেন্টকে এক ঝলক দেখার জন্য হাত নাড়ছে তাঁর দিকে তাকিয়ে। প্রেসিডেন্টও হাসিমুখে হাত নেড়ে চলেছেন অনর্গল জনতার সমুদ্রের দিকে। আচমকাই একটা আকাশ কাঁপানো শব্দ। প্রেসিডেন্টের হাত নড়ছে না আর। লিমুজিন গাড়ির মধ্যেই লুটিয়ে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। জনপ্রিয় মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএস চ্যানেলে যে ঘটনা সম্প্রচার করার সময় অনেক কষ্টে খবর সঞ্চালককে আবেগ আটকাতে দেখবে সমস্ত বিশ্ব তারপর।
গুলিটা লেগেছিল প্রেসিডেন্টের গলায়। আধঘণ্টার মধ্যে ডালাসের পার্কল্যান্ড হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয় কেনেডিকে। হসপিটাল কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেন, ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছেন প্রেসিডেন্ট কেনেডি।
মনে করা হয় রাস্তার পাশেই টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোজিটরি নামের একটি বহুতল গুদামঘর থেকে প্রাণঘাতী চালানো হয়েছিল প্রেসিডেন্টের উপর। ঘটনার দিনেই তড়িঘড়ি আটক করা হয় ওই গুদামের কর্মচারী হার্ভে অসওয়াল্ডকে। যদিও সন্দেহভাজন আততায়ী হিসেবে অসওয়াল্ড কিন্তু এই হত্যার দায় স্বীকার করেননি। করেননি? নাকি, করতে পারেননি? তার কারণ, ঠিক দু’দিন বাদে, ২৪ নভেম্বর খুন হয়ে যান অসওয়াল্ড নিজেই। ডালাসের একটি নাইট ক্লাবের মালিক জ্যাক রুবি খোদ ডালাস শহরের পুলিশের দফতরে ঢুকে গুলি করে খুন করেন অসওয়াল্ডকে। তারপর থেকেই সন্দেহ ঘোরতর হয় কেনেডি হত্যার ষড়যন্ত্রকে ঘিরে। চর্চা শুরু হয় সন্দেহভাজন হিসেবে অসওয়াল্ড এবং জ্যাক রুবির অতীত ইতিহাস নিয়ে।
আরও পড়ুন
ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে ভারতে চে গ্যেভারা, কলকাতায় আলাপ ‘কৃষ্ণে’র সঙ্গেও
লি হার্ভে অসওয়াল্ড মার্কিন নৌবাহিনীর সেনা ছিলেন। পরবর্তীকালে হাজার ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ সাল অবধি তিনি ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। মেক্সিকো সিটিতে কিউবা এবং রাশিয়ার দূতাবাসেও গিয়েছিলেন তিনি। জানা যায় যে, ঘোষিত ভাবে মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন প্রাক্তন মার্কিন সেনার এই কর্মচারী। অন্যদিকে জ্যাক রুবি দাবি করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট কেনেডি হত্যাকাণ্ড পাগল করে দিয়েছিল তাঁকে। তাই অপরাধীকে নিজের হাতে শাস্তি দিতেই অসওয়াল্ডকে হত্যা করেছিলেন তিনি। যদিও পরবর্তীকালে জ্যাক রুবির সঙ্গে অপরাধজগতের মাফিয়াদের নানারকম যোগাযোগের হদিশ পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে এই সন্দেহও বাড়তে থাকে যে, অসওয়াল্ড অথবা জ্যাক রুবি দাবার চালের বোড়ে মাত্র; আসলে পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন অন্য কোনও বড়ো মাথা।
যদিও এই সন্দেহ উড়িয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ারেন কমিশন। কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, অসওয়াল্ড বা জ্যাক রুবি কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কড়া নিরাপত্তার মধ্যে অসওয়াল্ডকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় কীভাবে সাংবাদিক এবং লাইভ টিভি ক্যামেরার সামনে জ্যাক রুবি তাঁকে গুলি করে হত্যা করতে পারল, সে বিষয়টি এখনও ধাঁধাই রয়ে গিয়েছে।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট কেনেডি হত্যার সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ৩০০০টি গোপন নথি প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার। যদিও আরও কিছু গোপন নথি প্রকাশ করা হবে বলেও সামনে আনা হয়নি ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র অজুহাতে। যে নথিগুলি প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে এই হত্যার রহস্য সম্পর্কে জট বেড়েছে আরও। প্রকাশিত একটি নথিতে দেখা যাচ্ছে যে, লি হার্ভে অসওয়াল্ডের নিজেরই প্রাণনাশের আশঙ্কা ছিল। হুমকিও পেয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও প্রেসিডেন্টকে হত্যার ব্যাপারে যে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, সেই ব্যাপারে পুলিশকে আগেভাগেই সতর্ক করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআই। কিন্তু পুলিশ প্রধানের তরফ থেকে আশ্বাস পাওয়া গেলেও কেন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তায় ফাঁক থেকে গেল, তা নিয়েও সন্দেহ থেকে যায়। প্রকাশিত আরও একটি নথিতে দেখা যাচ্ছে যে, অসওয়াল্ড মেক্সিকো সিটিতে গিয়ে যোগাযোগ করেছিলেন একজন কেজিবি অফিসারের সঙ্গে। রাশিয়ার এই কেজিবি অফিসারের অন্তর্ঘাত এবং গোপন হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করার পারদর্শিতা ছিল। এছাড়াও ব্রিটেনের ‘কেম্ব্রিজ নিউজ’ নামের একটি আঞ্চলিক সংবাদপত্রের দফতরে কেনেডি হত্যাকাণ্ডের কিছুক্ষণ আগেই একটি ফোন কল আসে। কোনো এক ‘অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি’র তরফে সেদিন বলা হয়েছিল যে, খুব তাড়াতাড়ি আমেরিকায় একটা ‘ধামাকা’ ঘটতে চলেছে। সেই খবর কি মার্কিন প্রেসিডেন্টের হত্যাকাণ্ডকেই নির্দেশ করেছিল?
আরও পড়ুন
ভারতে এসেই মার্কেজ বেপাত্তা, চিন্তিত ফিদেল কাস্ত্রো, পথে নামল পুলিশ
এদিকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অপর একটি মতবাদে বিশ্বাসীদের বক্তব্য, বাইরের কোনও গোষ্ঠী নয়, বরং মার্কিন সংগঠন সিআইএ-এর ষড়যন্ত্রেরই শিকার হয়েছেন প্রেসিডেন্ট কেনেডি। কারণ, যে বাড়ি থেকে অসওয়াল্ড গুলি চালিয়েছিল বলে বলা হচ্ছে, সেখান থেকে গুলি করে প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে হত্যা করা নাকি একপ্রকার অসম্ভবই ছিল। যদিও ১৯৭৫ সালের রকফেলার কমিশন কেনেডি হত্যাকাণ্ডে সিআইএ-এর জড়িত থাকার অভিযোগটিকে নাকচ করে দেয়।
তবে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে আমেরিকার মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের প্রাক্তন গভর্নর জেসি ভেঞ্চুরার বই ‘দে কিলড্ আওয়ার প্রেসিডেন্ট’ প্রকাশিত হওয়ার পর। এখানে লেখক সরাসরি বলেছেন যে, রাশিয়া অথবা অন্যান্য দেশে কেনেডির যত না শত্রু ছিল, তার থেকে অনেক বেশি শত্রু ছিল তাঁর নিজের আশেপাশেই। কমিউনিস্ট সরকারের কেনেডিকে হত্যার কোনো কারণই ছিল না, তার কারণ তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে সমঝোতায় যেতে চেয়েছিলেন। কিউবার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর মার্কিন সেনাদের সঙ্গে ব্যবসায়ী অথবা দেশের ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর অবৈধ বাণিজ্যিক চক্রও ভাঙতে চেয়েছিলেন তিনি। ভেঞ্চুরা নিজের বইতে লিখেছেন, কেনেডি বেঁচে থাকলে পৃথিবীটাই হয়তো অনেকটা অন্যরকম হত। ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো রক্তক্ষয়ী ইতিহাস দেখতে হত না আমাদের। তাই আধুনিক মার্কিন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন জন এফ কেনেডিকে।
তবে কেনেডি হত্যাকাণ্ডে কমিউনিস্ট সরকারের হাত নেই, এমন কথা ভেঞ্চুরা বললেও, বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ কিন্তু সেই সন্দেহ একেবারে উড়িয়ে দিতে দেয় না। যেমন, ১৯৭০ সালের একটি প্রকাশিত নথি থেকে জানতে পারা যায় যে, মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডির নেতৃত্বে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যা করার জন্য একাধিকবার চেষ্টা চালিয়েছিল মার্কিন সরকার। এই রবার্ট কেনেডি ছিলেন জন এফ কেনেডির ভাই। এমনকি ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যা করার জন্য কুখ্যাত খুনি নিয়োগ করা হয়েছিল বলেও অভিযোগ ওঠে। এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে যাবার ফলেই প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলেও মনে করেন কেউ কেউ।
আরও পড়ুন
গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের শীর্ষে ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবা
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির মৃত্যুর পরবর্তী দুই ঘণ্টা কিন্তু যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সময় ধরে চললে দেখা যাবে, গুলি লাগার আধঘণ্টার মধ্যে মারা যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। প্রেসিডেন্টকে গুলি করার এক ঘণ্টার মধ্যেই আবার হার্ভি অসওয়াল্ড আর একজন পুলিশ অফিসারকে গুলি করে হত্যা করেন। এবং প্রেসিডেন্ট কেনেডি মারা যাওয়ার মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ভাইস প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন। কেনেডির ঘাতক শোভাযাত্রায় প্রেসিডেন্টের গাড়ি থেকে মাত্র তিনটি গাড়ি পিছনে ছিল যাঁর গাড়ি।
সুতরাং প্রায় অর্ধ শতাব্দী বেশি কেটে গেলেও প্রেসিডেন্ট কেনেডির মৃত্যু রহস্য নিয়ে আজও থ্রিলার উপন্যাস লেখাই যায় একটা। শুধু সমস্যা হল, সেই উপন্যাসের শেষে অপরাধী হিসেবে ধরা পড়বে কে, সেটাই এখনও ঠিক হল না শুধু।
Powered by Froala Editor