‘লকড রুম মিস্ট্রি’ ও এক আশ্চর্য খুনের গল্প

আর পাঁচটা দিনের মতোই সকাল সকাল মালিকের বাড়িতে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন মেরি লারসেন। সকালবেলায় সাহেবকে চা-কফি বানিয়ে দেওয়া, ঘর পরিষ্কার করা— এসবই তাঁর কাজ। তবে বিস্তর ডাকাডাকির পরও সেদিন দরজা খুললেন না সাহেব। তাহলে কি এখনও ঘুম ভাঙেনি তাঁর? না, আর বিরক্ত করেননি মেরি। মেরি জানতেন কোথায় রাখা আছে দরজার ডুপ্লিকেট চাবি। সেটা দিয়েই দরজা খুলে বাড়ির ভেতরে ঢোকেন তিনি। তবে সাহেবের ঘরে গিয়েই রীতিমতো চোখ কপালে উঠে যায় মেরির। একি এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির দেহ পড়ে রয়েছে মাটিতে! ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে জমাট বাঁধা রক্ত!

১৯২০ সাল। ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা ১১ জুন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের এমনই এক আশ্চর্য ঘটনা সারা ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বজুড়ে। অপরাধ জগতে এই খুনের মামলা পরিচিত ‘এলওয়েল কেস’ (Elwell Case) নামে। 

হ্যাঁ, এই মৃত ব্যক্তির নাম জোসেফ এলওয়েল। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিলিয়নেয়ার ছিলেন তিনি। ব্রিজ খেলে উপার্জন করেছিলেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। তাছাড়াও তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন নিউইয়র্কের মহিলামহলে। যাই হোক, এই এলওয়েলই হল মেরির মালিক। ভাবছেন, এ কেমন ধাঁধাঁ, শুরুতেই যে বলা হল, মৃত ব্যক্তিকে মেরি নিজেই চিনতে পারেননি? আসলে মেরি তাঁর মালিককে চিনতে পারেননি অন্য এক কারণে। খুন করার পর, খুনি খুলে দিয়েছিল জোসেফ এলওয়েলের মাথার পরচুলা। উপড়ে ফেলেছিল সোনায় বাঁধানো দাঁত। কাজেই কেশহীন মালিকের মৃতদেহ দেখে ব্যাপারটা ঠাহর করতে পারেননি তিনি। 

এলওয়েলের খুনকে ‘রেয়ারেস্ট কেস’ বলেই অভিহিত করেছিলেন নিউইয়র্কের পুলিশ। প্রথম কথা, খুন হল, অথচ দরজা বন্ধ ভেতর থেকে। এ-কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই, বাড়ির চাবির প্রতিরূপ থাকলে, খুনি অনায়াসেই ঢুকে পড়তে পারবে বাড়ির ভেতরে। অনেকটা মেরির মতোই। কিন্তু বন্ধ দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার উপায় নেই কোনো। সেক্ষেত্রে খুনিকে দেখে ফেলতেন স্বয়ং মেরি। অথচ, দরজা খুলে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকেই দেখতে পাননি তিনি। 

আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, খুনির মোটিফ। এলওয়েলের বাড়িতে সাজানো ছিল সবমিলিয়ে কয়েক লক্ষ টাকার দুর্মূল্য সামগ্রী। কাঁচা টাকাও ছিল বিস্তর। তবে খুনি সেসব কিছুই নেয়নি। বরং, শুধুমাত্র প্রাণে মেরেছে এলওয়েলকে। এবং তার ক্রূরতার পরিচয় পাওয়া যায় এই খুনের প্রেক্ষাপট দেখেই। ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী, মাত্র ৫-৬ ফুট দূরত্ব থেকে গুলি চালানো হয়েছিল এলওয়েলের মাথায়। তারপর খুলে ফেলা হয় তাঁর পরচুলা। চিমটি দিয়ে মাথার ভেতর থেকে বার করে আনা হয় ০.৪৫ এসিপি বুলেট। সেটিকে সযত্নে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রেখে গিয়েছিল খুনি। 

এই মৃত্যু যে আত্মহত্যা নয়, তা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল খুলি থেকে বার করে আনা বুলেটটি থেকেই। কিন্তু কে দায়ী এই খুনের জন্য? না, কোনো স্পষ্ট প্রমাণ খুঁজে পাননি গোয়েন্দারা। কারণ ছিল না কোনো পায়ের ছাপ, ফিঙ্গার প্রিন্ট। এমনকি পাওয়া যায়নি ঘাতক পিস্তলটিকেও। তবে গোয়েন্দারা ভালোই বুঝেছিলেন, খুনি আদতে এলওয়েলের পরিচিত। আর সেই কারণেই তাকে বাড়িতে দেখেও চমকে ওঠেননি তিনি। বরং, কাউচে বসে বেশ কিছুক্ষণ গল্পও করেছেন খুনির সঙ্গে। অন্যদিকে উল্টোদিকের সোফায় বসেই আকস্মিক গুলি চালিয়েছিল খুনি।

মজার বিষয় হল, মেরি সর্বপ্রথম পুলিশের কাছে এলওয়েল খুনের খবর দিলেও, সাসপেক্ট লিস্ট বা সন্দেহভাজনদের তালিকায় নাম উঠেছিল তাঁর। অনেকেই মনে করেছিলেন আগের দিন রাতে খুন করে মেরি থেকে গিয়েছিলেন এই বাড়িতেই। পরে গোটা ব্যাপারটাই সাজিয়ে পুলিশকে ফোন করেন তিনি। তবে, এই সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যায় পরদিনই। মেরির পাড়া-প্রতিবেশিদের জেরা করে জানা যায়, সকালেই তাঁকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছেন তাঁরা। মেরির পর এই মামলার দ্বিতীয় প্রাইম সাসপেক্ট ছিলেন হেলেন ডার্বি। 

১৯০৪ সালে হেলেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এলওয়েল। এমনকি হেলেনের সূত্র ধরেই ব্রিজ এবং গ্যাম্বলিং-এর জগতে পা রাখা এলওয়েলের। অথচ, সময়ের আবহে ক্রমশ তিক্ত হয়ে ওঠে তাঁদের সম্পর্ক। তার একটা কারণ ছিল এলওয়েলের অত্যাধিক মহিলাপ্রীতি। ফলে ১৯২০ সালে বিবাহবিচ্ছেন হয় তাঁদের। খুন হওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় এলওয়েল ডিনারে গিয়েছিলেন ভিওলা ক্রস নামের এক মহিলার সঙ্গে। এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে হেলেন খুন করতে পারেন তাঁকে, সেই সম্ভবনাও ছিল প্রবল। তবে হেলেনের অ্যালিবাই ছিল বেশ স্পষ্ট। তদন্তের দ্বিতীয় পর্যায়ে তাঁকেও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। 

সন্দেহের তালিকায় এলওয়েলের বেশ কিছু গ্যাম্বলিং-পার্টনার থাকলেও, তাঁদের বিরুদ্ধেও কোনো তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি নিউইয়র্ক পুলিশ। এমনকি এলওয়েলের বাড়িতে ঢোকার বাড়তি চাবি কোথায় থাকে, তাও জানতেন না তাঁরা। সবমিলিয়ে এ যেন এক জটিল রহস্য। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তদন্ত চালানোর পর, এই খুনের ঘটনাকে অমীমাংসিত মামলা হিসাবে ঘোষণা করে মার্কিন পুলিশ। 

তবে এলওয়েল খুনের আশ্চর্য রহস্য তার জাল বিস্তার করে চলেছে আজও। আসলে এই খুনের পরই জন্ম নিয়েছিল হত্যারহস্যের একটি বিশেষ জঁর— লকড রুম মিস্টেরি। আর এই বিশেষ জঁরের জনক হিসাবে পরিচিত জন ডিকশন কার। এলওয়েল হত্যাকাণ্ডের আগেও এডগার অ্যালান পো’র লেখায় কিংবা শার্লকের গল্পে উঠে এসেছিল লকড রুম মিস্ট্রি। তবে দরজা বন্ধ অবস্থায় খুনের প্লট তৈরি হয়েছিল ডিকশনের হাতেই। তাছাড়া লকড রুম মিস্ট্রি ঠিক কতরকম হতে পারে, ‘থ্রি কফিনস’ বইতে তারও বর্ণনা দিয়েছিলেন ডিকশন। আশ্চর্য হতে হয় গল্প-উপন্যাসের পাতায় বহু লেখকই লকড রুম মিস্ট্রির সমাধান করলেও, রহস্যোন্মোচন হয়নি তার বাস্তব ভিত্তিটির!

Powered by Froala Editor