তাঁকে চেনেন না কেউই। অথচ জাপানি পুলিশের নাকের ডগায় বসেও ঘোল খাইয়ে দিয়েছেন। একবার নয়, দুবার। এমনকি কোনো কোনো পুলিশ অফিসার নাকি দেখেছেন তাঁকে। যদিও আততায়ী একজন না একটি দল, তাও জানেন না কেউ। শুধু একটি নাম পাওয়া যায় পুলিশের খাতায়। যে জাপানি নামটির বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘২১টি মুখওয়ালা রাক্ষস’। কিন্তু কে এই ২১ মুখের রাক্ষস? ৪ দশক ধরে সমাধান হয়নি সেই প্রশ্নের।
‘গ্লিকো-মরিনাগা কেস’ নামে মামলাটি জাপানের অন্যতম রহস্যময় ঘটনাগুলির একটি। এই অজানা আততায়ীর জন্য দুটি ক্যান্ডি কোম্পানি বাজার থেকে উঠে যায়। সারা দেশে মৃত্যুর আতঙ্ক দেখা দেয়। ১৯৮৪-৮৫ সাল। জাপানজুড়ে তখন এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা। আততায়ীও চুপ করে বসে নেই। বরং পুরো সময়টা পুলিশের সঙ্গে মশকরা করেই কাটিয়ে দিয়েছেন সেই ২১ মুখের আততায়ী।
ঘটনাটির শুরু ১৯৮৪ সালের ১৮ মার্চ। হঠাৎ এক রাতে অপহৃত হলেন এজাকি গ্লিকো কোম্পানির কর্ণধার এজাকি। আইসক্রিম থেকে হ্যাম বার্গার পর্যন্ত সব ধরণের খাবার সরবরাহ করলেও গ্লিকো কোম্পানির সবচেয়ে বেশি নাম ছিল ক্যান্ডির জন্য। পুডিং, চকোলেট, ক্যারামেলের এক বিশাল সম্ভার। জাপানিদের নয়নের মণি গ্লিকো কোম্পানির ক্যান্ডি। তার কর্ণধার অপহৃত। স্বাভাবিকভাবেই হইহই কান্ড টোকিও শহরজুড়ে। তবে আততায়ীর কোনো পাত্তা পেল না পুলিশ।
পুলিশ সন্ধান না পেলেও অবশ্য এজাকি নিজেই পালিয়ে এসেছিলেন। ফিরে এসে পুলিশকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, কোথায় তাঁকে বন্দি করা হয়েছিল। ভাবছেন তো, তাহলে রহস্য কোথায়? আসলে গল্পের শুরু এখান থেকেই। পুলিশ জায়গাটির সন্ধান পেলেও আততায়ীকে ধরতে পারল না। সারা শহর তল্লাশি করা হতে থাকল। এমন সময় সংবাদপত্রগুলিতে নিয়মিত এক ধরণের চিঠি আসতে থাকল। তাতে পুলিশের অকর্মণ্যতা নিয়ে হাসি-মশকরার পাশাপাশি মাঝে মাঝে কিছু সংকেত দেওয়া হত। যেন বা আততায়ীকে ধরিয়ে দেওয়ার কিছু রাস্তা। কিন্তু সেসব মামুলি তথ্য। আর এই মশকরা যিনি করছেন, চিঠিতে তাঁর জাপানি নাম লেখা। যার বাংলা অর্থ ‘২১টি মুখওয়ালা রাক্ষস’।
আরও পড়ুন
৬০ বছর আগে ধর্ষণ ও খুন, অপরাধীর পরিচয় খুঁজে দিল জিন টেকনোলজি!
এই হাসিমশকরার মাঝেই একদিন একটি বিস্ফোরক কথা লেখা হল। গ্লিকো কোম্পানির স্টোররুমে নাকি কয়েক বাক্স ক্যান্ডিতে সায়ানাইড মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংবাদপত্রে এই খবর প্রকাশ পেতেই শুরু হল মৃত্যুভয়। এর মধ্যে এজিকা সমস্ত বাক্স ফিরিয়ে এনে পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। কোথাও সায়ানাইডের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কিন্তু ততদিনে গ্লিকো-র ব্যবসা লাটে উঠে গিয়েছে।
আরও পড়ুন
প্রকাশ্য সভায় মনোবিদকে খুন, সমকামী সিলভারস্টাইনের ‘প্রতিবাদে’ হতবাক শ্রোতারা
২১ মুখের রহস্যময় ব্যক্তি আরও একটি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়, জাপানে গরম খুব বেড়েছে। তাই এবার তিনি ইউরোপে যাবেন। একবছর পর আবার ফিরে আসবেন। অবশ্য তাঁর ফিরে আসার জন্য এক বছর অপেক্ষা করতে হয়নি। সে-বছর সেপ্টেম্বর মাসেই ফিরে এলেন ২১ মুখের আততায়ী। এবারের লক্ষ্য মরিনাগা কোম্পানি। একইভাবে সংবাদপত্রে চিঠি লিখে জানানো হল, মরিনাগা কোম্পানির ২০টি ক্যান্ডি বাক্সে সায়ানাইড মেশানো হয়েছে। এই কথাটিও লেখা হয়েছে বেশ গুছিয়ে। যেন বা কোম্পানি একধরণের পরীক্ষার জন্য নতুন ফ্লেবার যোগ করেছে। তবে চিঠিতে একথাও বলা হয়, বাক্সগুলির গায়ে সতর্কতা চিহ্ন দেওয়া আছে।
আরও পড়ুন
একের পর এক খুন, জেল ভাঙার ‘কৃতিত্ব’; কেন আত্মসমর্পণ করলেন ‘বিকিনি কিলার’?
সত্যিই সতর্কতা চিহ্নযুক্ত বাক্স পেলেন বেশ কিছু বিক্রেতা। পুলিশের ফরেন্সিক ল্যাবে সেগুলি পরীক্ষা করা হল। এবং আগেরবার যা ঘটেনি তা এইবার ঘটল। সত্যিই সায়ানাইডের নমুনা পাওয়া গেল ২০টি বাক্সের ক্যান্ডিতে। বাকিগুলি স্বাভাবিক। ২১ মুখের আততায়ী আবারও চিঠি লিখে জানালেন যে এবার সব বাক্স সতর্কতা চিহ্ন ছাড়াই পাঠানো হবে। বিক্রেতারা কেউই আর মরিনাগা কোম্পানির ক্যান্ডি বিক্রি করতে রাজি নন। আবারও গোটা দেশে মৃত্যুভয়। এবারেও বন্ধ করে দিতে হল মরিনাগা কোম্পানি।
দুটি ঘটনার পর রহস্যজনকভাবেই বন্ধ হয়ে যায় এই উপদ্রব। অবশ্য তার আগে আততায়ী আবারও একটি চিঠিতে জানিয়ে দেয়, জাপানি ক্যান্ডি কোম্পানিদের উপর তার আর কোনো আক্রোশ নেই। এরপর সে অন্য কোথাও অন্য কোনো ধরণের খারাপ কাজ করবে। কিন্তু জাপানের ক্যান্ডি কোম্পানিদের সঙ্গে কোনো শত্রুতা করবে না।
সেই থেকে ফাইলবন্দি হয়ে আছে ‘গ্লিকো-মরিনাগা কেস’। আজও তার সমাধান হয়নি। শুধু সেই সময়ের একটি সিসিটিভি ফুটেজ থেকে এক রহস্যময় ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছিল পুলিশ। আর তাকে নাকি বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসার নানা সময় তদন্তের জায়গার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে। সেই আততায়ীর স্কেচও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু তার সন্ধান পাওয়া যায়নি কোথাও। অন্য কোনো দেশেও না।
Powered by Froala Editor