একই দেহে দুটি মাথা, এমন আশ্চর্য শিশুর জন্ম হয়েছিল বাংলাতেই

ইংল্যান্ডের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জিয়নস অফ লন্ডন। এই কলেজের মধ্যেই রয়েছে ছোট্ট এক আশ্চর্য জাদুঘর। ‘হান্টারিয়ান মিউজিয়াম’-খ্যাত (Hunterian Museum) এই জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নানা আশ্চর্য নিদর্শন। সেখানে গেলেই দেখা মিলবে, আশ্চর্য এক মানবকরোটির। অবশ্য একটি না বলে, অবশ্য দুটি করোটি বলাই শ্রেয়। কারণ, এই দুটি করোটিই একটি শিশুর। অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত এই করোটি দুটি। একটি মুখ সামনের দিকে। অন্যটি পিছনের দিকে ঊর্ধ্বমুখী। আরও অবাক হতে হয়, এই আশ্চর্য করোটির সম্পর্কে লিখিত বয়ানে চোখ রাখলে। ব্রিটেনের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আশ্চর্য এই নিদর্শন নাকি সংগ্রহ করা হয়েছিল বাংলা থেকেই।

১৭৮৩ সালের মে মাস। অখণ্ডবঙ্গের তমলুকের নিকটবর্তী ছোট্ট গ্রাম মণ্ডলঘাটে জন্মগ্রহণ করে 'টু হেডেড বয় অফ বেঙ্গল'-খ্যাত এই আশ্চর্য শিশুটি (Two Headed Boy Of Bengal)। অবশ্য তার নাম বা জন্মপরিচয়— সে-ব্যাপারেই স্পষ্ট কোনো তথ্য নথিভুক্ত নেই কোথাও। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলার বুক থেকে কীভাবে এই করোটি গিয়ে হাজির হল ইংল্যান্ডে? 

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে বলে রাখা দরকার, ছোট্ট শিশুটির জন্মবৃত্তান্ত। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই একপ্রকার তার অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন স্বয়ং তার মা। নেপথ্যে তার মস্তিষ্কের আশ্চর্য গড়ন। আসলে আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে গ্রামবাংলার ছবি আজকের মতো ছিল না মোটেই। হাসপাতাল নয়, বরং বাড়িতেই সন্তানপ্রসব করতেন নারীরা। প্রথমত, একই শিশুর দুটি মস্তিষ্ক যে আসলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা— সে-ব্যাপারে পূর্ণ সচেতনতা বা অভিজ্ঞতা কোনোটাই ছিল না সে-যুগের সাধারণ মানুষদের। পাশাপাশি অন্ধবিশ্বাস তো ছিলই। ফলে সদ্যোজাত সন্তানকে দানব বা অশুভ শক্তির প্রতীক হিসাবেই আগুনের ওপর ফেলে দেন স্বয়ং তার মা। অবশ্য মাতৃস্নেহে টানে, বড়ো কোনো ক্ষতি হওয়ার আগেই আবার তাকে উদ্ধারও করেছিলেন তিনি। 

কিছুদিনের মধ্যেই এই খবর ছড়িয়ে পরে দূরদূরান্তে। আশ্চর্য শিশুটিকে দেখতে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন হাজির হতে শুরু করেন মণ্ডলঘাটে। এমনকি জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, শিশুটিকে দেখিয়েই অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেন দরিদ্র কৃষক দম্পতি। তাঁদের কাছে যেন ‘বর’ হয়ে উঠেছিল ‘অভিশপ্ত’ শিশুটিই। মণ্ডলঘাট তো বটেই, পরবর্তীতে কলকাতার বিভিন্ন মেলাতেও ছোট্ট এই শিশুটিকে নিয়ে হাজির হতেন তার বাবা-মা। 

সে-যুগের বেশ কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা অনুযায়ী, দুটি মাথাই প্রতিক্রিয়া জানাত স্বতঃস্ফূর্তভাবে। দ্বিতীয় মস্তিষ্কটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ব্যক্তিত্ব। এমনকি প্রথম মস্তিষ্কটিকে স্তন্যপান করালে, লালা গড়াত দ্বিতীয় মুখটি দিয়ে। এমনকি পরবর্তীতে দুটি মুখই কথা বলতে পারত স্বতন্ত্রভাবে। যদিও দ্বিতীয় মস্তিষ্কটির ক্ষেত্রে চোখ, কান ও নাক সম্পূর্ণ বিকশিত ছিল না বলেই দাবি করেন পরবর্তী সময়ের চিকিৎসকরা। 

অবশ্য খুব বেশিদিন ঘোরেনি ভাগ্যের চাকা। ১৭৮৭ সালে, মাত্র চার বছর বয়সে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিষধর সাপের কামড়ে মৃত্যু হয় শিশুটির। সে-সময় মণ্ডলঘাটে রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল মানুষের। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে শিশুটির দেহ কিনে নিতে চেয়েছিলেন অনেকেই। চেয়েছিলেন, সেটি স্টাফ করে সংরক্ষিত করে রাখবেন নিজেদের বাড়িতে। সেই তালিকায় ছিলেন অনেক ব্রিটিশ সাহেবও। তবে শেষ পর্যন্ত রূপনারায়ণ নদের তীরে শিশুটিকে সম্মানজনকভাবে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেন তার মামা-বা। 

এর দিন কয়েকের মধ্যেই সমাধিক্ষেত্র থেকে শিশুটির দেহ চুরি করেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মী তথা সল্ট এজেন্ট মিস্টার ডেন্ট। মোটা টাকার বিনিময়ে তা বিক্রি করে দেন ইস্ট ইন্ডিয়ার উচ্চপদস্থ আধিকারিক ক্যাপ্টেন বুকানানকে। তাঁর হাত ঘুরেই ছোট্ট এই শিশুর করোটি পৌঁছায় ‘হান্টারিয়ান মিউজিয়াম’-এ। 

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী, এই বিশেষ শারীরিক অবস্থাটির নাম ‘ক্র্যানিওপ্যাগাস প্যারাসিটিকাস’ বা পরজীবী মস্তিষ্ক। যমজ ভ্রূণ মানব প্রতিকৃতি নেওয়ার আগে অনেক সময় সংযুক্ত থেকে যায় পরস্পরের সঙ্গে। সেক্ষেত্রেই এইধরনের বিকৃত করোটির সন্তান জন্মগ্রহণ করে বলেই অভিমত চিকিৎসকদের। তবে একই ব্যক্তির করোটির উপরে আরও করোটি সংযুক্ত থাকার নিদর্শন বিরলের মধ্যেও বিরলতম। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি ২ কোটি শিশুর মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে দেখা যায় ‘ক্র্যানিওপ্যাগাস প্যারাসিটিকাস’ অবস্থাটি। পাশাপাশি এইধরনের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই মৃত্যু হয় শিশুর। তবে বাংলার ছোট্ট শিশুটি এই সমস্ত প্রতিবন্ধকতা হারিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে ছিল কীভাবে— তা আজও অবাক করে চিকিৎসকদের!

তথ্যসূত্রঃ
১. The Two-Headed Boy Of Bengal, The Human Marvels
২. Craniopagus parasiticus. Everard Home's Two-Headed Boy of Bengal and some other cases, National Library Of Medicine, USA Govt.
৩. The Two-Headed Boy of Bengal, Kaushik Patowary, Amusing Planet

Powered by Froala Editor