ব্রিটেনের নিঃসঙ্গতম গ্রাম, কেন জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল গ্রামদুটি?

স্যালিসবারি প্লেইন। জায়গাটার নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্টোন হেঞ্জের ছবি। তবে উইল্টশায়ারের এই স্থানের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু রহস্যও। যাঁরা শার্লক হোমসের গল্প কিংবা হান্না মুরের লেখা পড়েছেন, রহস্যময় স্যালিসবারি সম্পর্কে খানিক অবগত। আর এই অঞ্চলেই লুকিয়ে রয়েছে এক আশ্চর্য শহর। অবশ্য শহর বললে ভুল হবে, গ্রাম। বছরের মাত্র ৫০টি দিন সাধারণের জন্য খোলা যায় সে-গ্রামের দরজা। 

ইম্বার (Imber)। স্যালিসবারি প্লেইনের (Salisbury Plain) অবস্থিত এই গ্রাম বর্তমানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অধীনে। সেখানে সারাবছরই চলে কোনো না কোনো অনুশীলন। যুদ্ধাস্ত্রের পরীক্ষানিরীক্ষা। ঠিক যেমনটা দেখানো হয়েছিল বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ অভিনীত ‘শার্লক’ ওয়েব সিরিজে। এই গ্রামে স্থায়ী বাসিন্দা নেই কোনো। তবে মজার বিষয় হল, ইম্বারের চেহারা চিরকালই যে এমনটা ছিল চিরকাল। একসময় এই গ্রাম ছিল ব্রিটিশ কর্মকারদের অন্যতম ঘাঁটি। তবে হঠাৎ কীভাবে জনশূন্য হয়ে পড়ল ইম্বার? কীভাবেই বা সেখানে রাজত্ব ফেঁদে বসল ব্রিটিশ বাহিনী?

পিছিয়ে যেতে হবে ৮০ বছর। বিশ্বযুদ্ধ তখন মধ্যগগনে। সে-সময় ব্রিটেনের অন্যতম সেনা ঘাঁটি তৈরি করা হয় স্যালিসবারি প্লেইনের ইম্বার ও টাইনেহাম— এই দুটি গ্রামে। ব্রিটেনের মূল শহরগুলি থেকে খানিক দূরে গ্রামে অবস্থিত হওয়ায় অক্ষ শক্তির বিমানহানার সম্ভাবনা কম ছিল বলেই এমন সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ প্রশাসন। 

১৯৪৩ সালে তরুণ যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নতুন নতুন যুদ্ধাস্ত্রের পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য বেছে নেওয়া হয় এই গ্রাম দুটিকে। কিন্তু এত বেশি সৈন্যকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য যত পরিমাণ সেনাছাউনি প্রয়োজন, তা ছিল না ইম্বারে। ফলে, দেশের স্বার্থে স্থানীয়দের উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ বাহিনী। স্থানীয়দের কাছে সময় দেওয়া হয় মাত্র ৫০ দিন। জানানো হয়, তার মধ্যেই ঘর-বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে যেতে হবে তাদের। যুদ্ধ শেষ হলে, তারা আবার ফিরতে পারবেন এই বাসস্থানে। 

অনেকে যুদ্ধের কথা ভেবেই ঘর ছেড়েছিলেন। কেউ আবার কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন শেষ সম্বল ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণায়, রাগে। শহর ফাঁকা হয়ে গেলে, পরিত্যক্ত বাড়িগুলিই হয়ে ওঠে সেনাদের অস্থায়ী বাসস্থান, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। তবে এই খবর পৌঁছে গিয়েছিল বিপক্ষের কাছেও। কাজেই বিশ্বযুদ্ধের শেষ দু’বছরে বেশ কয়েকবার জার্মান বিমানহানারও শিকার হয় ইম্বার। 

তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতি পড়লেও, গ্রামের অধিকার ফিরে পাননি স্থানীয়রা। বরং, সাঁজোয়া গাড়ি এবং ট্যাঙ্কের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে গুলিবর্ষণ করা হত এই গ্রামের বাড়িগুলিতে। তা নিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে জনরোষও। যাঁরা গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সেনাবাহিনীর আদেশে, তাঁদের নেতৃত্বে শুরু হয় ‘ফরএভার ইম্বার’ প্রতিবাদ। সেই বিক্ষোভে সামিল হয়েছিলেন দেশের বহু বুদ্ধিজীবীও। এমনকি ব্রিটেনের সংসদ ‘হাউস অফ লর্ডস’-এ উঠেছিল গ্রামবাসীদের কাছে বাসস্থান ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি। তবে লাভের লাভ হয়নি কিছুই। 

তারপর পেরিয়ে গেছে প্রায় ৭০ বছর। আজও অজস্র গুলি, বোমার ক্ষতচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে জনহীন ইম্বার ও টাইনেহাম গ্রাম। প্রতিবছর ৫০ দিনের জন্য সাধারণের জন্য এই গ্রামের দরজা খুলে দেওয়া হলেও, পথ ছেড়ে পরিত্যক্ত বাড়িগুলিতে ঢোকার অনুমতি পাননি পর্যটকরা। আর তার কারণ, সেখানে জমে থাকা অজস্র না-ফাটা বিস্ফোরক। গ্রামে পা রাখলেই রাস্তার ধারে কয়েক মিটার ছাড়া ছাড়াই দেখা মিলবে এ-সংক্রান্ত অসংখ্য সতর্কতাবার্তা। 

বর্তমানে হাজার বছর পুরনো এই গ্রামের একমাত্র প্রাণকেন্দ্র সেন্ট গিলস চার্চ। এই গির্জা তৈরি হয়েছিল ত্রয়োদশ শতকে। ১৯৪৩ সালে অন্যান্য বাড়িঘরের মতোই পরিত্যক্ত হয় এই গির্জা। তার ওপর দিয়েও ঝড়-জল কম যায়নি। তাকে কম অত্যাচার সইতে হয়নি সেনাদের। তবে ১৯৬০-এর দশকে এই গির্জা সংরক্ষণের বিশেষ উদ্যোগ নেয় ব্রিটিশ সরকার। দুই পাদ্রি ও ফাদারের বাস সেখানে। তাঁরাই এই গ্রামের ‘অস্থায়ী’ বাসিন্দা। তাঁদের সৌজন্যেই বেঁচে রয়েছে ‘ব্রিটেনের নিঃসঙ্গতম গ্রাম’ হিসাবে পরিচিত এই যমজ ঘোস্ট-টাউনের ইতিহাস…

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More