যমজ হয়েও বেড়ে ওঠা আলাদা, রাজনৈতিক বিশ্বাসই ‘এক’ হতে দেয়নি তাঁদের

সময়টা ১৯৫৪ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত তখন অনেকটাই সেরে উঠেছে। যুদ্ধের পরে ভাগ হয়েছে জার্মানি। ঠিক এই সময় ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগো শহর থেকে পশ্চিম জার্মানিতে এসেছেন এক ব্যবসায়ী। আর এখানেই দেখা হয়ে গেল আরেকজনের সঙ্গে। দুজনেই চমকে উঠেছিলেন একে অপরকে দেখে। এক মুখ, এক চোখ। এমনকি দুজনের পোশাকও অনেকটা একইরকম। ঠিক যেন শেক্সপিয়রের কমিডি অফ এররসের সেই বিখ্যাত দৃশ্য। তবে নাটকের রঙ্গমঞ্চে নয়, বাস্তবেই এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল দুই ভাইয়ের সঙ্গে। তার চেয়েও বড়ো বিষয়, দুই ভাইয়ের একজন হিটলারের নাৎসি (Nazi) শাসনে অত্যাচারিত হয়েছেন। আর অন্যজন ততদিনে হিটলারের আদর্শকেই বিশ্বাস করেছেন। তবু দুই যমজ ভাই (Twin Brothers) জ্যাক এবং অস্কারের সম্পর্কে পারস্পরিক ঘৃণার সঙ্গে সঙ্গে থেকে গিয়েছিল আত্মীয়তার আকর্ষণও।

১৯৩৩ সালে স্পেনের ত্রিনিদাদ বন্দর শহরে জন্মগ্রহণ করেন দুই যমজ ভাই জ্যাক এবং অস্কার। জন্মের ঠিক ৬ মাসের মধ্যে তাঁদের বাবা এবং মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। জ্যাক থেকে যান ত্রিনিদাদ শহরেই, ইহুদি (Jews) বাবার সঙ্গে। অন্যদিকে জার্মান ক্যাথলিক মায়ের সঙ্গে জার্মানিতে চলে আসেন অস্কার। সেই বছরই জার্মানির রাইখস্ট্যাগের পতন ঘটিয়ে হিটলারের নাৎসি শাসন শুরু হয়। বাড়িতে জার্মান ক্যাথলিক অনুশাসন এবং বাড়ির বাইরে নাৎসি শাসনে বেড়ে উঠতে থাকেন অস্কার। অন্যদিকে স্পেনে জ্যাক বড়ো হয়ে উঠতে থাকেন নাৎসি আতঙ্ক বুকে নিয়ে। তাঁদের যখন ৮ বছর বয়স, তখনই যুদ্ধের আঁচ এসে পড়ে ত্রিনিদাদ শহরে। হিটলার তখনও ত্রিনিদাদ দখল করতে পারেননি। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধঘাঁটি তৈরি হয়ে গিয়েছে।

এরপর নাৎসি অত্যাচারে বাবাকে হারিয়েছেন জ্যাক। এক পিসি এবং তিনি নিজে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসেন। যুদ্ধের পরেই জানতে পারেন, ইহুদিদের পিতৃভূমি ইজরায়েলে ফিরছেন বহু মানুষ। তাঁরাও আশ্রয় নেন ইজরায়েলে। ইতিমধ্যে ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের দ্বন্দ্বও শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে খুব বেশিদিন ইজরায়েলে থাকেননি তাঁরা। কিছুদিনের মধ্যেই চলে যান ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগো শহরে। সেখানে নানা ধরনের ব্যবসা শুরু করেন জ্যাক। আর এই ব্যবসার সূত্রেই এসেছিলেন পশ্চিম জার্মানিতে। সেখানেই দেখা হল দুই ভাইয়ের। দুজনেই জানতেন, তাঁদের অন্য এক যমজ ভাই রয়েছেন। কোথায় আছেন, তা জানতেন না। ফলে ভাইকে চিনে নিতে খুব অসুবিধা হয়নি।

তবু দুই ভাই পরিচয় জানার পরেও তাঁদের মধ্যে স্বাভাবিক যোগাযোগ তৈরি হয়নি কোনোদিন। দুজনের রাজনৈতিক বিশ্বাসের পার্থক্যই তাঁদের চিরকাল আলাদা করে রেখেছিল। আরও ২৫ বছর পর, ১৯৭৯ সালে জ্যাক জানতে পারেন মিনেসোটা ইউনিভার্সিটির গবেষকরা যমজ ভাইদের নিয়ে এক বিশেষ পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন অস্কারের সঙ্গে। এই পরীক্ষার বিষয়ে অবশ্য তিনি রাজি হয়েছিলেন। গবেষকরা জানিয়েছিলেন, দুজন সম্পূর্ণ পৃথক পরিবেশে বেড়ে উঠলেও তাঁদের চরিত্রের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। দুজনের খাবারের পছন্দ একইরকম। দুজনেই একই ধরনের পোশাক পরতে ভালোবাসেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, দুজনেই বিকট শব্দে নাক ডাকেন। এমনকি দুজনের মানসিক গঠনও অনেকটা একইরকম। কেউই অন্য পক্ষের মত মেনে নিতে পারেন না। আর এই সাদৃশ্যই তাঁদের চিরকাল আলাদা করে রেখেছিল।

আরও পড়ুন
পেশা নাৎসি-শিকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বাস্তব ‘অ্যাভেঞ্জার’-রা

১৯৯৭ সালে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান অস্কার। আর জ্যাকের মৃত্যু হয় ২০১৫ সালে। তাঁর জীবনও কেড়ে নিয়েছিল ক্যানসার। অবশ্য জ্যাকের ক্যানসার ধরা পড়েছিল পাকস্থলিতে। জন্ম থেকেই পৃথক হয়ে থাকা এই দুই যমজ ভাইকে নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা ডকুমেন্ট্রি। বেশ কিছু বইও লেখা হয়েছে তাঁদের ঘটনা নিয়ে। এক মলাটের নিচে জায়গা করে নিলেও কোনোদিন এক ছাদের নিচে জায়গা ভাগ করে নিতে পারেননি নাৎসি-ইহুদি ভাইরা।

আরও পড়ুন
৭ হাজারেরও বেশি শিশুকে নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন ‘দ্বিতীয় মা’

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
নাৎসিদের হাতে লুঠ হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধে, নিলামে ভ্যান গঘের আঁকা সেই ছবিই