পশ্চিম নেপালের (Nepal) ডাং জেলায় অবস্থিত তেরাই পর্বতের ওপর কুয়াশার মাফলারে মোড়া ছোট্ট একটা গ্রাম। হলুদ সরষের ক্ষেতের ওপর সারাদিনই সেখানে খেলা করে মেঘ-রোদ্দুর। এই গ্রামেই বসবাস প্রায় আড়াইশো মানুষের ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠীর। কুসুন্দা সম্প্রদায়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, তাঁরা যে ভাষা ব্যবহার করেন, তার সঙ্গে মিল নেই গোটা পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষাগোষ্ঠীরই। আরও অবাক করার বিষয় হল, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এই ভাষার শব্দকোষে ‘না’ নেই কোনো।
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। কোনো কাজকে অস্বীকার করে ‘না’ বলতে জানেন না কুসুন্দারা (Kusunda)। তাঁদের সংস্কৃতিতে প্রয়োজন পড়ে না নির্দেশেরও। ফলে, নির্দেশমূলক কিংবা নেতিবাচক কোনো শব্দই নেই কুসুন্দা ভাষার শব্দভাণ্ডারে। কিন্তু এমন অদ্ভুত ভাষার জন্ম হল কীভাবে? কুসুন্দাদের ইতিহাসই বা কী?
কুসুন্দা ভাষার জন্ম ঠিক কীভাবে, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত কোনো ধারণা নেই গবেষকদের। সাধারণত, নেপাল, ভুটান ও উত্তর-ভারতে ইন্দো-বার্মিজ, ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান এবং তিবেতিয়ান ভাষা পরিবারের ভাষার ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু কুসুন্দার সঙ্গে পারতপক্ষে কোনো যোগাযোগ নেই এই তিন ভাষা পরিবারেরই। ফলে অনেকেরই অভিমত, তিব্বত-বর্মা এবং ইন্দো-আর্য উপজাতির আগমনের আগে থেকেই ট্রান্স-হিমালয়ান অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই সুপ্রাচীন ভাষা। আর সেই কারণেই হয়তো এই ভাষায় নির্দিষ্ট কোনো ব্যাকরণ নেই।
১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত কুসুন্দারা মূলত যাযাবরজীবনেই অভ্যস্ত ছিলেন। নেপালের পার্বত্য অরণ্যে শিকার করে বেড়াতেন তাঁরা। ঝুম চাষের মাধ্যমে উৎপাদন করতেন গম। তারপর গ্রামের বিভিন্ন হাটে বিক্রি করতেন এইসব খাদ্যসামগ্রী। তবে ক্রমশ অরণ্যনিধন এবং নগরায়নের জেরে বর্তমানে তেরাই পর্বতে এসেই থিতু হয়েছেন তাঁরা। তাঁদের অস্তিত্বকে আরও বিপন্ন করে তুলেছে অরণ্যের জাতীয়করণ।
আরও পড়ুন
প্রাণীদের সঙ্গে কথপোকথন, পোষ্যের ভাষা শেখাচ্ছেন মার্কিন মহিলা
২০১১ সালের সেনসাস অনুযায়ী, বর্তমানে কুসুন্দাদের সংখ্যা মাত্র ২৭৩ জন। আশঙ্কার বিষয় হল, এই ২৭৩ জন মানুষের মধ্যে কেবলমাত্র একজন মহিলাই কেবল সম্পূর্ণভাবে এই ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারদর্শী। হ্যাঁ, অন্যান্য বহু আদিবাসী ভাষার মতোই ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে কুসুন্দা। তার একটি কারণ কুসুন্দাদের বিবাহপ্রথা। কুসুন্দারা নিজগোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে বিবাহ করেন না। বরং, তাঁদের বিবাহ হয় নেপালের অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই রীতি চলে আসায় বিপন্নতার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে কুসুন্দা ভাষা। তাছাড়াও চাকরির আশায় গ্রাম ছেড়েছেন অধিকাংশ মানুষ। সেদিক থেকেও বক্তা হারিয়েছে কুসুন্দা ভাষা।
আরও পড়ুন
ঔপনিবেশিক স্মৃতি মুছে ‘আফ্রিকার ভাষা’ সোয়াহিলি
এই প্রচীন ভাষাটি সংরক্ষণের জন্য ২০১৯ সালে বিশেষ উদ্যোগ নেয় নেপালের ভাষা কমিশন। শুরু হয় নথিকরণ এবং কুসুন্দা ভাষায় শিক্ষাদানের প্রক্রিয়াও। বিগত ৪ বছরে খানিকটা হলেও এগিয়েছে সেই কাজ। সরকারের সেই উদ্যোগে কি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে পারবে কুসুন্দা? সে-উত্তর দেবে সময়ই…
আরও পড়ুন
ফেব্রুয়ারি মাসেই ভাষা আন্দোলনের ডাক ঝাড়খণ্ডে
Powered by Froala Editor