উনিশ শতকের শুরুর দিকের কথা। সে-সময় বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাজত্ব ছিল ব্রিটিশদের হাতে। গোটা পৃথিবীজুড়ে তাঁদের সাম্রাজ্যের বিস্তার তখন ২.২ কোটি বর্গকিলোমিটার। ভারত থেকে উত্তর আমেরিকা গ্রিনল্যান্ড— সবটাই সেই সাম্রাজ্যের অংশ। তবে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যোগাযোগ মাধ্যম। পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে খবর পৌঁছাতেই সময় লেগে যেত কয়েক মাস। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে টেলিগ্রাফের সৌজন্য জুড়ে যায় ইউরোপ ও এশিয়া। কিন্তু আমেরিকা? সমুদ্রের তলা দিয়ে টেলিগ্রাফের তার নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। জল এবং বিদ্যুৎ যে একে অপরের চিরশত্রু। এখানে দাঁড়িয়ে প্রযুক্তির দুনিয়াকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিয়েছিল একটি গাছ। সেই গল্পেই ফেরা যাক বরং।
১৮৪২ সাল। এক অভিনব আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্জেন উইলিয়াম মন্টগোমেরি (William Montgomery)। সে-সময় সিঙ্গাপুরে কর্মরত তিনি। ছুটি কাটাতে গিয়ে সিঙ্গাপুরের অরণ্য থেকে এক বিশেষ গাছের সন্ধান পান। যার রস অনেকটা রাবারের মতোই। তবে বিশেষত্ব হল, এই উপাদানকে গরম জলে ফোটালেই তা নরম মণ্ডে পরিণত হয়। তারপর ধীরে ধীরে তাকে ঠাণ্ডা করলে, তা জমাট বেঁধে পরিবর্তিত হয় কঠিন পদার্থে।
ডাঃ মন্টগোমেরি এই গাছটির (Tree) নামকরণ করে গাটা পারচা (Gutta Percha)। যদিও স্থানীয় ভাষায় এই গাছ পরিচিত ‘গেটা পেরকা’ নামে। সে যাই হোক না, নামটা কি চেনা চেনা ঠেকছে? হ্যাঁ, আজও দাঁতের রুট ক্যানালের সময় ব্যবহৃত হয় এই জিলেটিনাস পদার্থ। গাটা পারচার এই ব্যবহার শুরু হয়েছিল সার্জেন মন্টগোমেরির হাত ধরেই। তবে শুধু দন্তচিকিৎসা নয়, সার্জারির ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্যও এই বিশেষ গাছের রস ব্যবহার করতেন তিনি।
চাঞ্চল্যকর এই আবিষ্কারের কথা, খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে। শুধু চিকিৎসা নয়, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গাটা পারচাকে ব্যবহার করতে শুরু করল নানা ধরনের বাণিজ্যিক উৎপাদনেও। বলা চলে, তৎকালীন সময়ে প্লাস্টিকের পরিপূরক ছিল এই গাটা পারচা। বিশেষত, গাটা পারচার অপরিবাহী চরিত্র বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল সে-সময়ের গবেষকদের। ফলে বৈদ্যুতিক তারকে অন্তরিত করতে তার উপর প্রলেপ পড়ল গাটা পারচার।
আরও পড়ুন
খবরের কাগজ থেকেই জন্ম নেবে গাছ, পথ দেখাচ্ছে জাপান
প্রযুক্তির দুনিয়ায় এই আবিষ্কার ছিল এক-কথায় যুগান্তকারী। গাটা পারচার সৌজন্যেই সমুদ্র-গর্ভস্থ টেলিগ্রাফ লাইনের মাধ্যমে জুড়ে গিয়েছিল এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকা। তবে এর কিছুদিনের মধ্যেই দেখা দিল সমস্যা। মূলত সিঙ্গাপুর, মালয় ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি থেকেই উৎপাদিত হত এই পদার্থ। আশ্চর্যের বিষয় হল, প্রায় ১০ টন বৃক্ষ কাটা হলে সেখান থেকে পাওয়া যেত মাত্র ৫০০ গ্রাম গাটা পারচা। ফলে, গোটা পৃথিবীকে টেলিগ্রাফ দিয়ে সংযুক্ত করতে ঠিক কত গাছ কাটা হয়েছিল, তা অনুমান করা যায় সহজেই। সরকারি নথি অনুযায়ী, প্রায় ১০ কোটিরও বেশি গাছ কাটা হয়েছিল ১৮৫০ থেকে ১৯০২ সালের মধ্যে। তারপর?
আরও পড়ুন
গাছ লাগিয়ে গোল উদযাপন, ফুটবলের সঙ্গে পরিবেশকে জুড়তে লড়াই
হ্যাঁ, মানুষের এই লোভের কারণেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হতে বসেছিল গাটা পারচা। ১৯০২ সালে বিলুপ্তপ্রায় গাছের তকমা দেওয়া হয় এই প্রজাতিটিকে। তা বলে তো উৎপাদন থেমে থাকতে পারে না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মানুষদের দিয়ে গাটা পারচার চাষ শুরু করল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। নিয়ম করেই প্রতিদিন বসানো হত গাটা পারচার চারা। যদিও সে-সব গাছের পরিণত হতেই লেগে যায় ২০-২৫ বছর। ততদিনে বাজারে এসে গেছে আরও এক নতুন প্রযুক্তি। ল্যাবরেটরিতে গবেষকরা বানিয়ে ফেলেছেন পলিমার। যাকে আমরা চিনি প্লাস্টিক হিসাবেই। যা তৈরি করা যায় অনেক স্বল্প খরচে। স্বাভাবিকভাবেই গাটা পারচার পরিবর্তে প্লাস্টিকের ব্যবহার শুরু করে ব্রিটিশরা। রক্ষা প্রায় আশ্চর্য বৃক্ষ প্রজাতিটি।
আরও পড়ুন
আলোক দূষণের শিকার উদ্ভিদরা, কৃত্রিম আলোর কারণে বদল গাছের দৈহিক ঘড়ির!
১৯৬০-এর দশক নাগাদ, রেডলিস্ট থেকে নামও সরিয়ে ফেলেছিল গাটা পারচা। তবে বর্তমানে ফের এই গাছ ঢুকে পড়েছে বিপদসীমায়। অবাধে অরণ্যনিধন এবং নগরায়নই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে গাটা পারচার। বর্তমানে গোটা বিশ্বজুড়ে বেঁচে আছে এই প্রজাতির মাত্র এক লক্ষ গাছ। কিন্তু যে গাছ একসময় বদলে দিয়েছিল টেলি-যোগাযোগের দুনিয়াকে, তাকে সংরক্ষণের জন্য তেমন কোনো আগ্রহই নেই মানব সভ্যতার…
Powered by Froala Editor