১৯৮৮ সালের ২১ ডিসেম্বর। লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে উড়ান নিয়েছিল ‘প্যান অ্যাম ফ্লাইট ১০৩’ বিমান। বোয়িং-৭৪৭ বিভাগের এই বিমানে সবমিলিয়ে ছিলেন ২৪৩ জন যাত্রী এবং ১৬ জন বিমানকর্মী। যার মধ্যে ৩৬ জন ছিলেন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া। গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের কেনেডি বিমানবন্দর। তবে গন্তব্যে পোঁছানো তো দূরের কথা, উড়ান নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মাঝ আকাশে বিস্ফোরিত হয় বিমানটি। ভেঙে পড়ে স্কটল্যান্ডের একটি ছোট্ট গ্রাম লকারবি-তে। সমস্ত যাত্রী এবং বিমানকর্মী ছাড়াও, এই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় আরও ১১ জন গ্রামবাসীর। সবমিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭০।
কীভাবে ঘটেছিল এই দুর্ঘটনা? না, ‘দুর্ঘটনা’ বললে ভুল হবে। বরং, ‘লকারবি ট্র্যাজেডি’-খ্যাত (Lockerbie Tragedy) এই ঘটনার নেপথ্যে ছিল বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, প্রতিশোধ স্পৃহা। যদিও সেই রহস্যের সমাধান খুঁজতেই কয়েক বছর পেরিয়ে যায় গোয়েন্দাদের। এমনকি আজও লকারবি দুর্ঘটনার তদন্ত করে চলেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।
এই চক্রান্ত, ষড়যন্ত্রের গল্পে যাওয়ার আগে বলে রাখা প্রয়োজন দুর্ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতির সম্পর্কে। বোয়িং-এর বিমানটি লন্ডন থেকে উড়ান নিয়েছিল সন্ধে সাড়ে ৬টা নাগাদ। সন্ধে ৭টা বেজে ২ মিনিটে, স্কটল্যান্ডের আকাশে দুর্ঘটনার শিকার হয় সেটি। তখন বিমানের আনুমানিক গতি ছিল প্রায় ৮০৪ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ছিল প্রায় ৯৪০০ মিটার। সে-সময় আচমকাই বিমানবন্দরের রাডার থেকে উধাও হয়ে যায় বিমানটি। সঙ্গে সঙ্গেই কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বিমানের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তাতে উত্তর মেলেনি কোনো। প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল কোনো যান্ত্রিক ত্রুটির শিকার হয়েছে প্যান অ্যাম ফ্লাইট ১৩০।
এর কয়েক মিনিট বাদেই পরিষ্কার হয়ে যায় গোটা ঘটনাটা। গ্লাসগো থেকে লন্ডন অভিমুখী ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের পাইলট রবিন চেম্বারলিন স্কটিশ কর্তৃপক্ষকে জানান, লকারবি-র ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়, মাটিতে প্রকাণ্ড একটি অগ্নিকুণ্ড দেখতে পেয়েছেন তিনি। কিন্তু কীসের এই অগ্নিকুণ্ড?
বিষয়টি যাচাই করতে সঙ্গে সঙ্গেই বিশেষ দল পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে। তবে ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে অনেকটা। উদ্ধারকারী দল যখন ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছায়, তখন মৃত্যু হয়েছে অধিকাংশ যাত্রী এবং বিমানকর্মীর। পাশাপাশি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি বাড়ি। দু’জন যাত্রীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হলেও, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই মৃত্যু হয় তাঁদের।
যুক্তরাজ্য এবং স্কটল্যান্ডের সরকার তো বটেই, ঘটনাটির তদন্তে জড়িয়ে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনও। কারণ, ভেঙে পড়া বিমানটির অধিকাংশ যাত্রীই ছিলেন মার্কিন নাগরিক। পাশাপাশি লন্ডন থেকে উড়ান নিলেও প্যান অ্যাম ফ্লাইট ১৩০ ছিল আমেরিকান ফেডারাল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বিমান।
এই দুর্ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয় বিমানের ভয়েস রেকর্ডার। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, সেখানে পাইলটদের কোনো বিপদ সংকেত বা বার্তা দিতেই শোনা যায়নি। পাশপাশি রেকর্ডিং-এর শেষ ১৮০ মিলিসেকেন্ডে শোনা যায় বিস্ফোরণের শব্দ। সেখান থেকেই অনুমান করা হয়, এই বিস্ফোরণে মাঝ-আকাশে দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল প্যান অ্যাম ফ্লাইট ১৩০। ককপিটটি পৃথক হয়ে যাওয়ার পর বিমানের মূল অংশটি আকাশে টর্নেডোর মতো ঘুরতে ঘুরতে আছড়ে পড়ে মাটিতে। তারপর দ্বিতীয়বার বিস্ফোরণের শিকার হয় বিমানটি।
প্রাথমিক এই ঘটনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় কোনো যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে বিস্ফোরিত হয়নি বিমানের ইঞ্জিন বা অন্যান্য অংশ। বরং, অভ্যন্তরীণভাবে বোমা দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল বিমানের মধ্যে। কিন্তু কীভাবে বোমা লাগানো হয়েছিল বিমানের মধ্যে? কে-ই বা সেই বোমা প্রতিস্থাপন করেছিল বিমানে?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আরও দু’বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল গোয়েন্দাদের। প্রমাণ মেলে বিস্ফোরক পদার্থটি রাখা হয়েছিল একটি স্যুটকেসে। পাশাপাশি সেখানে রাখা হয়েছিল তোশিবা বোমবিট-এর একটি রেডিও তথা ক্যাসেট প্লেয়ার এবং শিশুদের একটি জামা। যে-জামাটি ক্রয় করা হয়েছিল মাল্টার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। স্বাভাবিকভাবেই এই চক্রান্তে জড়িয়ে যায় লিবিয়ার নাম। অনুমান করা হয়, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমী দুনিয়ার কর্মকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতেই এই বোমাটি প্ল্যান্ট করা হয়েছিল বিমানে। বিস্তারিত তদন্তে উঠে আসে লিবিয়ান নাগরিক তথা সাবেক ইন্টেলিজেন্স অফিসার আবদেল বাসেত আল-মেগ্রাহির নাম।
অবশ্য ১৯৯০ সালে এই তদন্ত শেষ হলেও, মেগ্রাহির নাগাল পেতে লেগে যায় আরও কয়েক বছর। তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন লিবিয়ার একনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফি। ২০০০ সালে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। বিচারে ২০ বছরের কারাদণ্ড হয় মেগ্রাহির। যদিও ২০০৯ সালে প্রোস্টেড ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ায় কারাবাস থেকে মুক্তি পান তিনি।
অবশ্য লকারবি ট্র্যাজেডির রহস্য এখানেই শেষ নয়। পরবর্তীতে এফবিআই ও সিআইএ-র তদন্তে উঠে আসে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল সিরিয়ার একটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী। পাশাপাশি এই হামলার মদত জুগিয়েছিল ইরান। ১৯৮৮ সালে এই দুর্ঘটনার ছ’মাস আগে ইরানের একটি বাণিজ্যিক বিমানে আক্রমণ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী। তাতে মৃত্যু হয়েছিল ২৯০ জন মানুষের। মূলত সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই লকারবি হামলা করা হয়। এবার এই আদেশ দিয়েছিল তৎকালীন ইরানের স্বর্বাধিনায়ক আলি খামেইনি স্বয়ং। ইরানের গোয়েন্দা বাহিনীও নানাভাবে সাহায্য করেছিল এই হামলা চালানোর জন্য। ২০১৪ সালে এই তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর, এখনও চলছে তদন্ত। এখনও এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করে চলেছেন গোয়েন্দারা। কবে বিচার মিলবে নিহতদের? জানা নেই উত্তর…
Powered by Froala Editor