পেরে লাচেইসে। প্যারিসের সবচেয়ে বড়ো সমাধিক্ষেত্র হিসাবেই পরিচিত এই সেমেট্রি। গারট্রুড স্টেইন, জিম মরিসন, রতনজি টাটা, ওস্কার ওয়াইল্ড-সহ একাধিক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বরা শায়িত রয়েছেন এই কবরস্থানেই। তবে এই সমাধিক্ষেত্রে একদম শেষ প্রান্তে গেলে দেখা মিলবে আশ্চর্য এক সমাধির। আর পাঁচজন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের সমাধির থেকে বেশ খানিকটা আলাদা এই স্মৃতিমন্দির। সেই অর্থে চাকচিক্য নেই কোনো। এপিটাফ লেখা, ‘সোফি ব্ল্যাঙ্কার্ড— ভিকটিম ডে সন আর্ট এট ডে সন ইন্ট্রোপিডিটি’। পাশে আঁকা একটা জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের ছবি। ফরাসি কথাটির বাংলার করলে দাঁড়ায়, ‘যিনি নিজেরই শিল্প এবং সাহসিকতার শিকার’।
কে এই সোফি ব্ল্যাঙ্কার্ড (Sophie Blanchard)? কীভাবে প্রাণ দিতে হতেছিল তাঁকে? কেনই-বা এই সমাধিক্ষেত্রে ফ্রান্সের (France) উচ্চপদস্থ সেনাপতি ও অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে একই সারিতে জায়গা দেওয়া হয়েছিল এই মহিলাকে?
এই গল্পের সূত্রপাত উনিশ শতকের শুরুর দিকে। প্যারিসে তখন বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে বেলুন-অভিযান। আজকের দিনে মহাকাশভ্রমণ যেমন খরচ সাপেক্ষ, সে-সময় বেলুনে চেপে আকাশে ঘুরে বেড়ানোও ছিল অনেকটা তেমনই। ফলে, তা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে ছিল। আবার প্রাণনাশের আশঙ্কায় সম্ভ্রান্তরাও আকাশে ওড়ার সাহস দেখাতেন না খুব একটা। তবে সে-যুগে প্যারিসের বুকে জন্ম হয়েছিল বিশেষ এক গোত্রের স্টান্টম্যানদের। যাঁরা সাধারণের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘বেলুনিস্ট’ নামে। বেলুনে চেপে আকাশে উঠে নানারকম খেলা দেখাতেন তাঁরা।
অষ্টাদশ-উনিশ শতকের এমনই এক কিংবদন্তি বেলুনিস্ট জঁ-পিয়ের ব্ল্যাঙ্কার্ড। আর সোফি তাঁরই স্ত্রী। প্রাথমিকভাবে বেলুন তো দূরের কথা, এমনকি ঘোড়ার গাড়িতে চাপতেও রীতিমতো ভয় পেতেন সোফি। গাড়ির আওয়াজে দমবন্ধ হয়ে আসত তাঁর। অথচ, জঁ-পিয়েরের সংস্পর্শে এসে এই সোফিই হয়ে ওঠেন প্যারিস তথা বিশ্বের প্রথম মহিলা বেলুন-চালক। প্রাথমিকভাবে অনেকে বিষয়টিতে ভুরু কোঁচকালেও, শেষ অবধি সাধারণ মানুষের জনপ্রিয়তা আদায় করে নেন সোফি।
সোফির এই জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮০৪ সালে। সে-সময় ব্ল্যাঙ্কার্ডের ব্যবসা রীতিমতো ডুবতে বসেছে। কখনও কয়েক হাজার ফুট উচ্চতা থেকে প্যারাসুট নিয়ে ঝাঁপ দেওয়া, কখনও মাঝ আকাশ থেকে জীবন্ত কুকুরকে ফেলে দেওয়া— প্রদর্শনীতে নিত্যনতুন খেলা দেখিয়েও দর্শকদের ভিড় বাড়াতে পারছেন না কিছুতেই। সে-সময়ই এক বন্ধুর থেকে আশ্চর্য এক পরামর্শ পান জঁ-পিয়ের। তাঁর এই খেলাতে নাকি একজন মহিলা সহকর্মীকে হাজির করলেই রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে উঠবে তাঁর শোম্যানশিপ। আর সেই আশাতেই, সোফিকে নিজের কাজে নিয়োগ করেছিলেন পিয়ের।
১৮০৪ সাল। প্রথমবার জঁ-পিয়েরের সঙ্গে বেলুনে চেপে আকাশ-অভিযান সোফির। তার আগে অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরে চলেছিল তাঁর প্রশিক্ষণ এবং মানসিক প্রস্তুতির পর্ব। তবে প্রথমবার এই দুঃসাহসিক অভিযানে সামিল হওয়ার পরই, সোফির মন থেকে রীতিমতো উড়ে যায় ভয় শব্দটাই। এমনকি বেলুনে চড়া নেশা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর। পিয়েরের পাশাপাশি অল্পদিনের মধ্যে তিনিও হয়ে উঠেছিলেন দক্ষ বেলুনচালক। এমনকি মাঝ আকাশ থেকে দেখাতেন বিভিন্নরকম স্টান্ট।
এর বছর দুয়েকের মধ্যেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সোফি এবং পিয়ের। ঘুরতে শুরু করেছিল ব্যবসার চাকাও। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছিল পিয়ের এবং সোফির এই প্রদর্শনী। তবে সঙ্গ দেয়নি ভাগ্য। ১৮০৯ সাল, হেগ শহরের ওপর দিয়ে ওড়ার সময় বেলুনেই হৃদরোগে আক্রান্ত হন পিয়ের। মাটিতে নামার আগেই মৃত্যু হয় তাঁর। কিছুই করার ছিল না সোফির।
এদিকে তখন ফ্রান্সে কয়েক হাজার টাকার দেনা রয়েছে ব্ল্যাঙ্কার্ড দম্পতির। সোফির হাতে নোটিস পৌঁছাল, ঋণের বোঝা না মেটাতে পারলে বাজেয়াপ্ত হবে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি। ফলে, স্বামীর মৃত্যু তাঁকে তাড়া করে বেড়ালেও, বেলুন-উড্ডয়নের এই ঘাতক খেলা দেখিয়ে চলেন সোফি। দর্শকদের আকর্ষিত করতে চালু করেন আতশবাজির প্রদর্শনীও। বেলুনে চড়া অবস্থায় আকাশে আতসবাজি ফাটাতেন সোফি।
ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ তো বটেই, সোফির এই আশ্চর্য খেলা মুগ্ধ করেছিল খোদ ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নকেও। এমনকি সোফিকে ‘এরোনট অফ দ্য অফিসিয়াল ফেস্টিভ্যাল’-এর তকমা দেন নেপোলিয়ন। নেপোলিয়নের রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানে বেলুন প্রদর্শনীর দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। তাছাড়া নেপোলিয়নের পুত্র সন্তানের জন্মের পর, রাজার আদেশে উড়ন্ত বেলুন থেকে গোটা প্যারিস শহরে লিফলেট বিতরণ করেছিলেন সোফি। শুধু নেপোলিয়নই নন, নেপোলিয়ন পরাজিত হওয়ার পর ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন অষ্টাদশ লুই। তাঁর দরবারেও যথেষ্ট সম্মান পেয়েছিলেন বিশ্বের প্রথম মহিলা বেলুনচালক। হয়ে উঠেছিলেন ফ্রান্সের সরকারি ‘এরোনট’।
সে-সময় শুধু প্যারিস বা ফ্রান্সই নয়, ফ্রান্সের প্রতিনিধি হিসাবে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি-সহ প্রায় গোটা ইউরোপেই নানা দেশে খেলা দেখিয়েছেন তিনি। ১৮১০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ফ্রাঙ্কফুর্টে ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় বেলুন নিয়ে পৌঁছে গড়েছিলেন তৎকালীন বিশ্বের ‘বিশ্বরেকর্ড’। কখনও আবার একটানা শূন্যে কাটিয়েছিলেন ১৪ ঘণ্টা।
তবে শেষ পর্যন্ত এই খেলাই যে জীবন কাড়বে তাঁর, তা কে-ই বা জানত। আসলে, সে-যুগে মন্টগোলফিয়ার ভ্রাতৃদ্বয়-সহ অধিকাংশ বেলুনচালকই ব্যবহার করতেন ‘হট এয়ার বেলুন’। যা আজও ব্যবহৃত হয় ইউরোপের বহু অংশ। তবে পিয়ের এবং সোফি হেঁটেছিলেন একটু অন্যপথে। তাঁরা ব্যবহার করতেন হাইড্রোজেন বেলুন। হাইড্রোজেন বাতাসের থেকে হালকা হওয়ায় তা দ্রুত আকাশে উড়তে সক্ষম ছিল। পাশাপাশি আয়তনে ছোটো হলেও, বেশি উচ্চতায় পৌঁছাতে পারত এই বেলুন। তবে এই হাইড্রোজেনই শেষ পর্যন্ত কারণ হয়ে দাঁড়ায় দুর্ঘটনার।
১৮১৯ সালের ৬ জুলাই। প্যারিসের টিভোলি গার্ডেনে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেন সোফি। সে-বারও তাঁর এই প্রদর্শনীতে দেখানোর কথা ছিল ‘বেঙ্গল ফায়ার’ নামের একটি বিশেষ আতসবাজির খেলা। বেলুনে সমস্ত সামগ্রী বোঝাই করে ওড়াও শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি। এমন সময় যেন বিদ্রোহ জানায় প্রকৃতি। হঠাৎ ঝড়ে মাটি থেকে সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায় সোফির বেলুনের। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বেলুনটি আটকে যায় একটি গাছে। গাছের ডালের সঙ্গে বেলুনের পোডিয়াম অর্থাৎ যাত্রীবাহী আসনের ঘর্ষণে তৈরি হয় স্ফুলিঙ্গ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আগুন ধরে যায় বেলুনে, বিস্ফোরিত হয় বেলুনে থাকা আতসবাজিও। উপস্থিত দর্শকদের কথায়, সবমিলিয়ে এক ভাসমান অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছিল সোফির বেলুন।
অবশ্য অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়নি সোফির। বরং, বিস্ফোরণের জেরে বেলুন থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। প্রায় দেরশো ফুট উচ্চতা থেকে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল তাঁর ঘাড়। মৃত্যু হয়েছিল ঘটনাস্থলেই। ফ্রান্স তো বটেই, সোফির মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা ইউরোপ। ফরাসি সম্রাটের আদেশে বিশেষ সম্মাননার সঙ্গে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল পেরে লাচেইসে সেমেট্রিতে।
পরবর্তীতে জুলে ভার্নের ‘ফাইভ উইকস ইন এ বেলুন’, ফিওদোর দস্তয়েভস্কির ‘দ্য গ্যাম্বলার’-সহ নানান গল্প-উপন্যাসেও ফিরে ফিরে এসেছে সোফির স্মৃতি। এমনকি সোফির এই ট্র্যাজিক মৃত্যু সম্পর্কে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন চার্লস ডিকেন্সও।
তারপর পেরিয়ে গেছে প্রায় দুশো বছর। বদলেছে যুগ। বিমান চালনা থেকে মহাকাশাভিযান— কোনোক্ষেত্রেই পিছিয়ে নেই মহিলারা। তবে সাম্যের এই লড়াই শুরু হয়েছিল সোফি ব্ল্যাঙ্কার্ড তথা শোম্যান ‘সোফি মেডেলিন’-এর হাত ধরেই। সে-কথা কজনই বা মনে রেখেছি আমরা?
Powered by Froala Editor