রুক্ষশুষ্ক জমির ওপর সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অজস্র ছোটো ছোটো বাড়ি। ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে দু-একটা ভাঙা গাড়ির ‘মৃতদেহ’, জলের পাইপ। রাস্তার ধারে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে জং ধরা লোহার ল্যাম্পপোস্ট, এমনকি বিজ্ঞাপন টাঙানোর প্রকাণ্ড বিলবোর্ড। কিন্তু মানুষের হদিশ নেই কোনো।
সোয়ানসি (Swansea)। না, ওয়েলসের উপকূলবর্তী শহরের কথা হচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (USA) অ্যারিজোনায় (Arizona) গেলে দেখা মিলবে এই জনহীন ভূতুড়ে শহরের। তবে এই শহরের ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে ওয়েলস। সেই গল্পে না হয় পরে আসা যায়। আপাতত ফিরে যাওয়া যাক এই শহরের ইতিহাসে।
আয়তনের দিক থেকে দেখতে গেলে ভারতের থেকে ভারতের থেকে কমপক্ষে তিনগুণ বড়ো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে জনসংখ্যা ভারতের এক চতুর্থাংশেরও কম। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষই বসবাস করেন দেশের পূর্বদিকে, বিশেষত উপকূলবর্তী অঞ্চলে। অন্যদিকে মেক্সিকো সীমান্তে অবস্থিত অ্যারিজোনা ল্যান্ডলকড বা ভূ-বেষ্টিত একটি অঙ্গরাজ্য। ফলে, অ্যারিজোনায় মানুষের বসবাস খুবই কম।
উনিশ শতকের শেষ দিক সেটা। একাধিক গবেষণায় উঠে আসে, এই জনহীন অ্যারিজোনার পেটের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে মহামূল্য সম্পদ— কয়লা থেকে শুরু করে কোবাল্ট, সোনা, তামা-সহ একাধিক খনিজ। শুধু অ্যারিজোনাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের গোটা পশ্চিমাঞ্চল জুড়েই রয়েছে খনিজের প্রাচুর্য। স্বাভাবিকভাবেই দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্যই একাধিক খনি স্থাপন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। খননের কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন পড়ে বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের।
বিসবি, গ্লোব থেকে শুরু করে উইকেনবার্গ— আমেরিকার গোটা পশ্চিমাঞ্চলে সে-সময় গড়ে উঠেছিল এধরনের একাধিক শহর। যার মধ্যে অন্যতম সোয়ানসি। বা বলতে গেলে, সোয়ানসিই ছিল নবনির্মিত এইসকল শহরের মধ্যে অন্যতম। খনি শ্রমিকদের থাকার কোয়ার্টার, রেল ডিপো, কবরস্থান, শ্যাফট— সমস্ত কিছুই নির্মাণ করা হয়েছিল খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই।
প্রাথমিকভাবে এই শহরের বাসিন্দা ছিলেন মাত্র ৫০০ মানুষ। ১৯০৭-৮ সাল থেকেই হঠাৎ করে বরাত খুলে যায় সোয়ানসির। হাজার হাজার মানুষ এসে বসতি স্থাপন করেন এই অঞ্চলে। তবে শুধু খনির ওপরে নির্ভর করেই তো একটা গোটা শহর চলতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, থিয়েটার, সেলুন, রেস্তোরাঁ, সমাধিক্ষেত্র ও অন্যান্য পরিকাঠামোরও। তবে সে-সব তৈরিতে তখনও পর্যন্ত হাত লাগায়নি মার্কিন প্রশাসন।
এই সুযোগকেই কাজে লাগান ওয়েলস ব্যবসায়ী নিউটন ইভানস এবং থমাস জেফারসন ক্যারিগান। বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে ঢেলে সাজিয়ে তোলেন এই শহরকে। চালু করা হয় দৈনিক যাত্রীদের জন্য বাস এবং রেল পরিষেবাও। ওয়েলস শহর ‘সোয়ানসি’-র নামানুসারেই এই শহরের নামকরণ করা হয় সোয়ানসি। যা স্থানীয়দের মুখে মুখে পরিচিত ছিল সোয়ানসি গ্রিন নামে। ১৯০৯ সালে প্রথাগত শহরেরও তকমা পায় সোয়ানসি।
তবে দু’বছরের মধ্যে এক ধাক্কায় কয়েক হাজার মানুষের সমাগম ঘটলেও ভাগ্য পরিবর্তন বদলায়নি দুই ওয়েলস ব্যবসায়ীর। তার কারণ, কাজের অভাব। যে পরিমাণ কর্মীর প্রয়োজন ছিল সোয়ানসিতে, কাজের আশায় সেখানে এসে হাজির হয়েছিলেন তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও কাজের হদিশ পাননি তাঁরা। পাশাপাশি খনির শ্রমিকরা যে প্রচুর বেতনও পেতেন, তেমনটা নয়। ফলে, শহর হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার বছর দুয়েকের মধ্যেই ধীরে ধীরে সোয়ানসি ছাড়তে থাকেন অসংখ্য মানুষ। ১৯১১ সালেই এই শহরের অর্ধেকের বেশি মানুষ ফের স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছিলেন অন্যত্র। অবশ্য খনির শ্রমিকরা তখনও ছিলেন এই শহরের বাসিন্দা। ১৯৪৩ সালে সোয়ানসির শেষ খনিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সম্পূর্ণভাবে জনশূন্য হয়ে পড়ে এই অঞ্চল।
পরবর্তীতে এই শহরটিকে অধিগ্রহণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিবিভাগ তথা ব্যুরো অফ ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিএলএম)। না, নতুন করে মানুষের বসতি গড়ে তোলার কোনো উদ্যম দেখায়নি তারা। তবে বাণিজ্যিকভাবে এই শহরের লাভ তুলতে, চালু করা হয় ক্যাম্পিং সাইট। সবমিলিয়ে পরিত্যক্ত এই শহরে ছড়িয়ে রয়েছে ৫টি ক্যাম্পিং সাইট। তাছাড়া অফ-রোডিং ড্রাইভিং বা রাইডিং-এর জন্যও রীতিমতো প্রসিদ্ধ এই শহর। বিএলএম-এর দপ্তরে টাকা দিলেই পাওয়া যায় ছাড়পত্র। বলতে গেলে, মৃত্যুর পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পকেটে অর্থ ভরে চলেছে এই ঘোস্ট টাউন। আর সেই কারণেই হয়তো অন্যান্য পরিত্যক্ত শহরের থেকে খানিকটা হলেও আজও এই শহরকে ‘গুছিয়ে’ রেখেছে মার্কিন প্রশাসন…
Powered by Froala Editor