শুধু দেশের সেরাই নয়, বিদেশেও সমান আদৃত বাংলার পরিচালক-ত্রয়ী

কথায় আছে, ‘হোয়াট বেঙ্গল থিংস টুডে, ইন্ডিয়া থিংস টুমরো’। সাহিত্য, চিত্রকলা বা সঙ্গীত— ভারতের সৃজনশীলতার দুনিয়ায় বার বার নবজাগরণের পীঠস্থান হয়ে উঠেছে বাংলা। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি তাঁর। এবার তা আরও একবার প্রমাণিত হল আন্তর্জাতিক সমীক্ষায়। সম্প্রতি সেরা ১০ ভারতীয় ছবির তালিকা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেডারেশন অফ ক্রিটিক’ (International Film Federation of Critic)। আর সেই তালিকায় প্রথম তিনটির ছবির নেপথ্যেই রয়েছেন তিন বাঙালি কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা— সত্যজিৎ (Satyajit Ray), মৃণাল (Mrinal Sen) এবং ঋত্বিক (Ritwik Ghatak)।

‘আইএফএফসি’-র সমীক্ষা অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত ভারতের সেরা চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’। বলা চলে, এই সিনেমার হাত ধরেই ‘নিওরিয়্যালিজম’-এর সূচনা হয়েছিল ভারতে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়ার পর, বাংলার সাধারণ জনগণের থেকে সাড়া পেতে বেশ খানিকটা সময় লাগে ‘পথের পাঁচালী’-র। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে আরও বছর খানেক বাদে। ১৯৫৬-তে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘শ্রেষ্ঠ মানব ইতিহাসের দলিল’ হিসাবে ওসিআইসি পুরস্কার পায় সিনেমাটি। তাছাড়াও এডিনবরা, রোম এবং বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবেও একাধিক সম্মাননা পেয়েছে এই চলচ্চিত্র। ১৯৫৮ সালে নিউ ইয়র্কের ফিফথ অ্যাভেনিউ প্লেহাউসে প্রায় ৮ সপ্তাহ ধরে দেখানো হয়েছিলও।

এ তো গেল ‘পথের পাঁচালী’-র কাহিনি। ‘আইএফএফসি’-এর সেরা দশের তালিকায় এর পরই রয়েছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এবং ‘ভুবন সোম’। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ জনসাধারণের সামনে তুলে ধরেছিল শরণার্থী-জীবনকে। পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের দৃষ্টিভঙ্গি, ভাষার ব্যবহার কিংবা অভিনয়— প্রতিটি ক্ষেত্রে নজির গড়েছিল ‘মেঘে ঢাকা তারা’। নব্বই-এর দশকেও নেদারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফেবিও চলচ্চিত্র উৎসবে শতকের সেরা ছবি বিভাগে বিশেষ স্ক্রিনিং হয়েছে এই চলচ্চিত্রের। ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ চলচ্চিত্র পত্রিকার প্রকাশিত সর্বকালীন সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় এই ছবি রয়েছে ২৩১তম স্থানে। 

‘মেঘে ঢাকা তারা’ মুক্তি পাওয়ার প্রায় ৯ বছর পর, ১৯৬৯ সালে তৈরি হয়েছিল মৃণালের ‘ভুবন সোম’। অবশ্য এই ছবি বাংলা নয়, হিন্দি ভাষার। এটি মৃণাল সেনের প্রথম ‘ব্যবসাসফল’ ছবিও বটে। ‘ভুবন সোম’-কে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের ‘নিউ ওয়েভ’-এর কাণ্ডারি বললেও ভুল হয় না এতটুকু। এই ছবির জন্য ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের ডাক পান মৃণাল। তবে যাত্রাপথেই ঘটে গিয়েছিল এক বিপত্তি। বিমানযাত্রায় হারিয়ে গিয়েছিল ভুবন সোমের শেষ রিল। মঞ্চে দাঁড়িয়ে সিনেমার শেষ অংশটুকু ফরাসি ভাষায় গল্প বলে শোনানো হয়েছিল উপস্থিত দর্শকদের। তা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচকদের স্তুতি পেয়েছিলেন মৃণাল। 

কয়েক দশক পেরিয়েও ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে এই তিন ছবির স্থান, জনপ্রিয়তা এখনও অটুট রয়েছে, তা আরও একবার প্রমাণিত হল ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেডারেশন অফ ক্রিটিক’-এর রিপোর্টে। উল্লেখ্য, এই তালিকা প্রস্তুতিতে বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র সমালোচকদের মধ্যে চালানো হয়েছিল একটি বিশেষ সমীক্ষা। তাঁদের অভিমতের ওপর ভিত্তি করেই প্রকাশিত হয় সর্বকালীন সেরা ১০ ভারতীয় চলচ্চিত্রের তালিকা। বাংলার কিংবদন্তি তিন পরিচালক বাদে, এই তালিকায় রয়েছেন আদুর গোপালকৃষ্ণণ, শ্যাম বেনেগাল, গিরীশ কাসারাবল্লির মতো পরিচালকরাও…

Powered by Froala Editor