মিউজিয়াম থেকে চুরি গেল মোনালিসা, নকল ছবি বিক্রি করে কোটিপতি আর্জেন্টিনার ব্যবসায়ী

রেনেসাঁর যুগের চিত্রশিল্পের কথা বললেই প্রথম মনে আসে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা। ১৫১৭ সালে শিল্পীর কাছ থেকে এই ছবিটি কিনেছিলেন ফরাসি সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিস। মূল্য ছিল চারহাজার ফ্লোরিন। আর্ট কোনৌজারদের মতে, দামটা নিতান্ত কম ছিল। বর্তমানে ছবিটির মূল্য হওয়া উচিত অন্তত ৮৫০ মিলিয়ন ডলার।

পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান শিল্পসম্পদ মোনালিসা। কিন্তু দীর্ঘদিন স্বীকৃতির অন্তরালে ছিল সেটি। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ফ্রান্সের শিল্পসমালোচকরা রেনেসাঁর শিল্পশৈলীর আদর্শ উদাহরণ হিসাবে বারবার মোনালিসার উল্লেখ করলে ক্রমশ তা পরিচিতি পেতে থাকে। কিন্তু তাও কেবলমাত্র যারা শিল্পজগতের টুকটাক খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছেই। তামাম বিশ্ববাসীর কাছে মোনালিসা জনপ্রিয় হয়েছে অনেক পরে।

কী আছে মোনালিসা ছবিতে? কীসের জন্য রেনেসাঁ যুগের অন্য সব ছবিকে ছাপিয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মোনালিসা? তার ঠোঁটের কোণায় হাসির আকর্ষণ? চোখের ভুরুর অনুপস্থিতি? মোনালিসার মডেল নিয়ে একঝাঁক রহস্য? না, এগুলো কোনোটাই কারণ নয়। মোনালিসার জনপ্রিয়তার আসল কারিগর একজন চোর।

প্যারিসের বিশ্ববিখ্যাত সংগ্রহশালা ল্যুভর থেকে মোনালিসার মতো বিখ্যাত চিত্রটি অপহরণ করার মতো অবিশ্বাস্য সাহস আর বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিল সেই চোর। দিনটা ১৯১১ সালের ২০ আগস্ট। ল্যুভর পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগ্রহশালা। মোনালিসার সঙ্গেই সেখানে ছিল রাফায়েল, বোতিচেল্লি থেকে শুরু করে ভ্যান গখ বা রেনের পৃথিবী বিখ্যাত সব ছবি। স্বাভাবিকভাবেই কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা। কিন্তু এসবের মাঝখান থেকে মোনালিসা চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনায় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। সঙ্গে সঙ্গে সরকারি তদন্ত কমিটির ৩৩টি বেসরকারি দল তদন্ত শুরু করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমাধান হল না কিছুই। ফ্রান্স প্রশাসনের ব্যর্থতা নিয়ে সরব হয় সমস্ত আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম। মোনালিসার ইম্প্রেশন ছবি ছাপা হয়। আর তারপরেই সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে যায় একটি নাম, মোনালিসা। রেনেসাঁর যুগের ছবি বলতেই লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা।

বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যম ফ্রান্স প্রশাসনের নিন্দায় সরব। ফ্রান্সের পুলিশও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। এটুকু সন্দেহ করাই যাচ্ছিল, এই চুরির সাথে কোনো দক্ষ শিল্পীর যোগসাজস রয়েছে। ল্যুভর মিউজিয়ামে যাতায়াত আছে এমন সমস্ত শিল্পীকে ধরে ধরে জেরা করতে থাকে পুলিশ। শোনা যায় এই ঘটনার সূত্রে চরম পুলিশি হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছিল পিকাসোকেও।

তবে শেষপর্যন্ত মোনালিসার সন্ধান পাওয়া গেল। দিনটা ১৯১৩ সালের ২৯ নভেম্বর। ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত শিল্পব্যবসায়ী আলফেদ্রো গেরির হাতে এলো এক রহস্যময় চিঠি। চিঠির প্রেরকের নাম নেই। লেখাও কিছু বোঝা যায় না। কোন ভাষায় লেখা, তাও না। কিন্তু ফ্লোরেন্সের মানুষ গেরি। সেই যেখানে জন্মেছিলেন লিওনার্দো। সেই যেখানে বসে এঁকেছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পোট্রেট লা-জ্যাকোন্ডা ওরফে মোনালিসা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই চিঠির রহস্য ধরে ফেললেন গেরি। ঠিক লিওনার্দোর অনুকরণেই লেখা হয়েছে চিঠি। আয়নার সামনে ধরতেই ফুটে ওঠে পরিষ্কার ইতালিয় অক্ষর। কিন্তু গেরির জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল। স্বয়ং লিওনার্দো বিক্রি করতে চান তাঁর মোনালিসা। গেরি বুঝতে পারেন লিওনার্দো রহস্যের জট এবার প্রায় খুলে এসেছে। ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত উফিজি সংগ্রহশালার ডিরেক্টর জোভানি পেগপির সঙ্গে বসে ফাঁদ পাতলেন তিনি। আর সেই ফাঁদে এসে পড়ল ইতালিয়ান রাজমিস্ত্রি ভিনসেঞ্জো পেরুগিয়া। সঙ্গে লিওনার্দোর আঁকা আসল মোনালিসা।

চোর ধরা পড়েছে, মোনালিসা উদ্ধার করা গেছে। পেরুগিয়া নিজের মুখে বর্ণনা করেছে, কীভাবে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে থেকে অপহরণ করেছে মোনালিসা। কিন্তু ইতালির পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। ফ্রান্স ও ইতালির জাতিবিদ্বেষ দীর্ঘদিনের। সেই জাতিবিদ্বেষ থেকে অনেক মনগড়া গল্পের জন্ম। সেরকমই একটা গল্প রাজা ফ্রান্সিস কর্তৃক মোনালিসা অপহরণের গল্প। অন্য অনেকের মতোই একথা বিশ্বাস করতেন পেরুগিয়া। আদালতে অকপটে সে জানায়, ইতালির সম্পদকে ইতালিতে ফিরিয়ে এনেছে সে। ইতালির মানুষের জাতীয়তাবোধ চাগার দিয়ে ওঠে। পেরুগিয়া তাদের নায়ক। তবে লিওনার্দো নিজে তার ছবি ফ্রান্সের রাজার কাছে বিক্রি করেছিল শুনে মর্মাহত হয় পেরুগিয়া। কারাবাসের মেয়াদ শেষে আবার ফ্রান্সে ফিরে যায়। রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করে। আর মোনালিসা ফিরে আসে ল্যুভরে, ১৯১৪ সালের ৪ জানুয়ারি।

মোনালিসা ফিরে এসেছে। পেরুগিয়া ধরা পড়েছে। কিন্তু রাঘব বোয়ালের সন্ধান পায়নি কেউ। অথচ ততদিনে পৃথিবীর নানা জায়গায় প্রায় হাফ ডজন মোনালিসা বিক্রি হয়ে গেছে। প্রত্যেকেই জানতেন তাঁরা ল্যুভর থেকে চুরি যাওয়া আসল মোনালিসা কিনেছেন। মোনালিসার ফিরে আসার ঘটনায় তাঁরা হতবাক। পেরুগিয়ার কাজ ছিল শুধু মোনালিসা চুরি করা। কারণ মোনালিসা চুরি না গেলে যে 'আসল মোনালিসা' বিক্রি করা সম্ভব নয়। আদালতে পারুগিয়া সমস্ত দোষ নিজের কাঁধে নিয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর অনেক গোয়েন্দা ও সাংবাদিকই সমীকরণটা ঠিক মেলাতে পারছিলেন না।

সেই অমীমাংসিত রহস্যের টানেই প্যারিসে উপস্থিত হন মার্কিন সাংবাদিক মার্টিন ডেকার। তখন ১৯৩২ সাল। প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও ডেকারের প্রশ্নের কাছে হার মানেন পেরুগিয়া। খুলে বলেন সমস্ত ঘটনা। জানা যায় ঘটনার মূল আর্জেন্টিনার ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড ওয়ালফিয়েরনো এবং ফরাসি শিল্পী ইভেস সান্দ্রো। ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের প্রাচীন প্রত্নশিল্পের বেআইনি ব্যবসা দিয়ে হাতেখড়ি ওয়ালফিয়েরনোর। কিন্তু বেশিদিন সে ব্যবসা চলেনি। তারপরেই রিও ডি জেনেরিওর এক সংগ্রহশালায় আলাপ সন্দ্রোর সঙ্গে। সান্দ্রোর হতে ডাচ শিল্পী মুরিল্লোর একটি ছবির অসাধারণ নকল দেখেই ব্যবসার প্রস্তাব দেন ওয়ালফিয়েরনো। সন্দ্রোও রাজি হয়ে যান। তারপর দুজনে মিলে মুরিল্লো, ভার্মিয়ার, ড্যুরারের মতো জনা দশেক শিল্পীর প্রতিকৃতি নকল করে সেগুলি আসলের মূল্যে বিক্রি করেন।

প্রতারণাকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ওয়ালফিয়েরনো। কিন্তু তাঁর সমস্ত চতুরতা আস্তে আস্তে ধরা পড়ে যাচ্ছিল। তখন দুজনেই ব্যবসা গোটানোর পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু ওয়ালফিয়েরনো বললেন, জীবনের শেষ কাজটা করে তাঁরা ব্যবসা গোটাবেন। আর তাঁর শেষ লক্ষ্য ল্যুভরে মোনালিসা। ওয়ালফিয়েরনোর কথায় সান্দ্রো বিস্মিত হন। কিন্তু শেষপর্যন্ত রাজি হয়ে যান। তারপর একবছর ধরে সান্দ্রো মোনালিসার নকল করে গেছে, আর চুরি ও বিক্রির অন্যান্য দিকগুলো দেখেছেন ওয়ালফিয়েরনো। কিন্তু নকল ছবি বিক্রির জন্য মোনালিসা চুরি যাওয়া দরকার। সেই কাজটাই পেরুগিয়াকে দিয়ে করিয়েছিলেন ওয়ালফিয়েরনো। মাত্র ৪৫ হাজার ফ্রাঁ-এর বিনিময়ে কাজটি করেছিলেন পেরুগিয়া। আর কয়েক কোটি ডলার উপার্জন করেছিলেন ওয়ালফিয়েরনো এবং সান্দ্রো। তবে এসব তথ্য যখন জানা যায়, তখন দুজনেই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন।

বিশ্ব অপরাধ জগতের ইতিহাসে এক আশ্চর্য ঘটনা মোনালিসার অপহরণ। প্রায় সাত দশক ধরে এই ঘটনার চর্চা চলেছে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে জনপ্রিয় হয়েছে মোনালিসা। চিরকাল তো রহস্যের আড়ালেই থেকেছে মোনালিসা আর তার শিল্পী দা ভিঞ্চি। তার অপহরণের ঘটনার সব রহস্যের নিষ্পত্তি নাই বা হল!

সূত্র - দ্য ডে দে স্টোল দ্য মোনালিসা, স্যামুয়ের রাইট
দ্য ম্যান হু স্টোল দ্য মোনালিসা, মারিয়া পেরেজ
মোনালিসার প্রেমে, নারায়ণ সান্যাল

More From Author See More

Latest News See More