দেশ থেকে বিমানে চেপে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছিলেন ইউরোপিয়ান ব্যক্তি। বিমানের টিকিট, কাগজপত্র— সবই ছিল, তবে বিমানবন্দরে নামার পরেই গ্রেপ্তার হতে হয় তাঁকে। এদিকে নিজের দেশেও ততদিনে ডুবে গেছে গৃহযুদ্ধ, অরাজকতায়। এমত পরিস্থিতিতে বিমানবন্দরই হয়ে ওঠে তার ঘর।
স্পিলবার্গ পরিচালিত ‘দ্য টার্মিনাল’ (The Terminal) চলচ্চিত্রের এই গল্পের সঙ্গে পরিচিত অনেকেই। ২০০৪ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল বক্স অফিসে। তবে মজার বিষয় হল, এই সিনেমার গল্প সম্পূর্ণ মনগড়া নয়। বরং, তা নির্মিত বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতে। মেহরান করিমি নাসেরি (Mehran Karimi Nasseri)— এই ইরানি ব্যক্তিটির চরিত্রকেই সিনেমার পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন টম হ্যাঙ্কস। দু-এক বছর নয়, দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে বিমানবন্দরই ছিল তাঁর ঘরবাড়ি, মাথা গোঁজার ঠাঁই। এবার সেই বিমানবন্দরেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।
১৯৪৫ সালে নাসেরির জন্ম ইরানের খুজেস্থানে। সেখানেই বেড়ে ওঠা তাঁর। অবশ্য তাঁর মা দেশ ছেড়েছিলেন আগেই। ১৯৭৩ সালে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ব্রিটেনে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন নাসেরি। সুযোগও মিলে যায় ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। ততদিনে ইরানে শুরু হয়ে গেছে গৃহযুদ্ধ। এই গৃহযুদ্ধের কারণেই দেশে ফেরা দায় হয়ে ওঠে নাসিরির। ইরানের শেষ শাহ রাজবংশের শাসক রাজা মহম্মদ রেজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য, ইরান প্রশাসন তাঁর প্রত্যাবর্তনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সে-সময় এমনটাই জানিয়েছিলেন নাসিরি।
একদিকে যখন দেশে ফেরার রাস্তা বন্ধ, অন্যদিকে সে-সময় ভিসার সময়ও ফুরিয়ে এসেছে তাঁর। ১৯৭৭ সাল থেকে বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে ঠাঁই পাওয়ার জন্য আবেদন শুরু করেন নাসেরি। তবে বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র— প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ থেকেই। কারণ, অভিবাসনের জন্য যে প্রশাসনিক কাগজ থাকে, তা ছিল না নাসেরির কাছে। উদ্বাস্তুর মতোই ঘুরে বেড়াতেন ব্রিটেন ও ফ্রান্সের পথে। ১৯৮৮ সালে প্যারিসের শার্দ দে গল বিমানবন্দরে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ফরাসি পুলিশ। অবশ্য পরবর্তীতে বিচারে নির্দোষ এবং অসহায় প্রমাণ হলে, তাঁর প্রতি খানিক সদয় হয় ফরাসি প্রশাসন। প্যারিস বিমানবন্দরের ২ নম্বর টার্মিনালে অস্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি পান তিনি।
১৯৯৯ সালে ফ্রান্সের নাগরিকত্ব পেলেও, ২০০৬ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় ১৮ বছর এই বিমানবন্দরেই কাটিয়েছেন নাসেরি। এই বিমানবন্দরই হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবিকা অর্জনের জায়গা। যাত্রীদের ট্রলি ও ব্যাগেজ ঠেলে দেওয়াই ছিল তাঁর কাজ। বাকি সময় ব্যস্ত থাকতেন পড়াশোনা এবং ডায়েরি লেখায়। সে-সময় গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন তিনি। একাধিক পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছিল তাঁকে নিয়ে। আর স্পিলবার্গের ছবির কথা তো বলা হয়েছে আগেই।
২০০৬ সালে নিজের সামান্য উপার্জন দিয়েই প্যারিসের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে চলে যান নাসেরি। দীর্ঘ ১৬ বছর সেখানে কাটানোর পর, চার-পাঁচ দিনে আগে ফের বিমানবন্দরে ফিরে এসেছিলেন প্রবীণ ইরানি অভিবাসী। সম্প্রতি শার্দ দে গল বিমানবন্দরের ২ নম্বর টার্মিনালেই হৃদরোগে মৃত্যু হয় তাঁর। চিকিৎসকদের অভিমত ‘সম্পূর্ণ স্বাভাবিক’ এই মৃত্যু, তাতে রহস্যের ছাপ নেই কোনো। কিন্তু সত্যিই কি রহস্যের ছাপ নেই? কেনই বা জীবনের শেষ লগ্নে পুরনো ‘ঠিকানা’-য় ফিরে এসেছিলেন তিনি? কে জানে?
Powered by Froala Editor