ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সৌজন্যে আজকের দিনে ঘরে বসেই দেখা যায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সিনেমা, সিরিজ। সেই তালিকায় রয়েছে হাড় হিম করা ভৌতিক গল্পও। তাছাড়াও টেলিভিশনেও কোনো-না-কোনো চ্যানেলে ভৌতিক সিরিয়াল বা নাটক বছরভর চলেই। অথচ আজ থেকে একশো বছর আগেও ভৌতিক কাহিনি কেবলমাত্র ছিল পাঠ এবং শ্রবণযোগ্য। ফলে, চোখের সামনে অলৌকিক কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেতেন সকলে— এমনটা একেবারেই নয়। কিন্তু কবে টেলিভিশন বা বড়ো পর্দার ‘কনটেন্ট’ হয়ে উঠল ভৌতিক কাহিনি?
পিছিয়ে যেতে হবে ন-দশক। ১৯৩১ সাল। প্রথমবার ক্যামেরাবন্দি করে দর্শকদের সামনে প্রস্তুত করা হয়েছিল ভৌতিক কাহিনি। ‘দ্য টেলিভিশন ঘোস্ট’ (The Television Ghost)। পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম দৃশ্যমান ভৌতিক কাহিনি হিসাবে নাম লিখিয়েছিল এই টেলিভিশন সিরিজ। নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক (New York) শহরের ‘ডব্লু২এক্সএবি’ স্টেশন।
এই সিরিজ বা সিরিয়ালের ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে, তৎকালীন প্রেক্ষাপটের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করে দেওয়ার খানিক প্রয়োজন আছে। কারণ, টেলিভিশন বলতে আজ আমরা যা বুঝি, তৎকালীন মানুষদের ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৯২৭ সাল। স্কটিশ ইঞ্জিনিয়ার জন বায়ার্ড তৈরি করেন এই আশ্চর্য যন্ত্র। যেখানে শব্দ শোনার পাশাপাশি দেখা যায় ছবিও। তারপর সেই যন্ত্রে আরও বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন অন্যান্য দেশের গবেষকরাও। অবশ্য সে-যুগে সাদাকালো পর্দায় যে-ছবি দেখা যেত, তা স্পষ্ট ছিল না মোটেই। ফলে, সাধারণ মানুষদের কাছে টেলিভিশন তখনও পর্যন্ত এক বিশেষধরনের রেডিও। ফলে, এই যন্ত্রের বাড়তি কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই মনে করতেন না অনেকে।
১৯৩১ সালে যখন ‘দ্য টেলিভিশন ঘোস্ট’ সিরিজটির জন্ম হয়, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, ব্রিটেনেও হাতে গোনা কিছু মানুষের কাছেই উপলব্ধ ছিল টেলিভিশন। এশিয়া, আফ্রিকা ও অনান্য অঞ্চলে টেলিভিশন তখনও কল্পবিজ্ঞানের অঙ্গমাত্র। যাই হোক, ফিরে আসা যাক বিশ্বের প্রথম ভৌতিক সিরিজের প্রসঙ্গে। টেলিভিশন তখনও পর্যন্ত প্রথাগত গণমাধ্যম না হয়ে ওঠায়, এই সিরিজ তৈরির জন্য বাড়তি কোনো উদ্যোগ বা কসরত করেনি ‘ডব্লু২এক্সএবি’ স্টেশন। বরং, মূল অনুষ্ঠানটি তৈরি করা হয়েছিল রেডিও-র শ্রোতাদের জন্যই। সেটিরই একটি দর্শনযোগ্য সংস্করণ দেখানো হত রেডিও-তে। কেমন ছিল সেই সিরিজ?
১৫ মিনিটের এই সিরিজের প্রতিটি পর্বে প্রতিদিন শোনানো হত একটি করে ভৌতিক কাহিনি। খুন, ধর্ষণ কিংবা দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের আত্মা এসে নিজমুখে গল্প শোনাতে তাদের অতীতের। সেইসঙ্গে শোনাত মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে তাদের অবস্থার কথা। সবটাই যে কাল্পনিক এমনটা নয়। কখনও কখনও যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া সত্যিকারের খুন-জখমের গল্পও হয়ে উঠত বিষয়বস্তু। তবে মজার বিষয় হল, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে ভৌতিক আত্মাদের চরিত্রে অভিনয় করতেন একজনই— জর্জ কেল্টিং।
স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, একজন পুরুষ কীভাবে মহিলার চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন? আর তা যদি করেও থাকেন তবে দর্শকদের চোখে সেটা বাধবে না কোথাও? না, তেমন ঘটনা ঘটেনি বললেই চলে। এমনকি একজন অভিনেতাই যে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছেন, সেটুকুও বুঝতে পারেননি তৎকালীন দর্শকরা। তার বেশ কিছু কারণও আছে। প্রথমত, সে-যুগে ঝিরঝির করা সাদা-কালো টেলিভিশনে স্পষ্ট ছবি দেখা যেত না একেবারেই। ফলে ‘ভূত’-এর আবছা অবয়বটুক দেখেই শান্ত থাকতে হত দর্শকদের। পাশাপাশি গোটা সিরিজটিই শ্যুট করা হত কেল্টিং-কে চেয়ারে বসিয়ে। কেবলমাত্র তার মুখের ওপরেই ফোকাস করত ক্যামেরা। দেহের বাকি অংশ আবছা করে দেওয়া হত। আর তারপর বসানো হত ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির কণ্ঠস্বর। মজার বিষয় হল, কেল্টিং-এর মেক-আপেও খুব বেশি বিনিয়োগ করতে হয়নি পরিচালকদের। বাজার চলতি হ্যালোউইন কস্টিউম, সাদা তোয়ালে বা কাপড়, জোকারদের ব্যবহৃত মুখে লাগানোর সাদা রং— এসবেই দিব্যি কাজ চলে যেত সে-যুগে।
তবে এই অতিসাধারণ সিরিজই রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল নিউ ইয়র্ক শহরে। যাঁদের বাড়ি টেলিভিশন নেই, তাঁরাও দল বেঁধে কখনও কখনও পাড়া প্রতিবেশীদের বাড়ি হাজির হতেন এই ভৌতিক সিরিয়াল প্রত্যক্ষ করার জন্য।
১৯৩১ সালের ১৭ আগস্ট থেকে শুরু করে ১৯৩৩-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি— দীর্ঘ দু’বছর ধরে চলেছিল এই বিশেষ অনুষ্ঠান। তারপর গ্রেট ড্রিপ্রেশন অর্থাৎ ঐতিহাসিক মন্দার কারণে বন্ধ হয়ে যায় খোদ টেলিভিশন চ্যানেলটিই। ১৯৩৯ সালে ‘ডব্লু২এক্সএবি’ ফের টেলিভিশন শো শুরু করলেও ‘দ্য টেলিভিশন ঘোস্ট’ ফিরে আসেনি আর। অবশ্য ততদিনে এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের অনুকরণ ধরে বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো শুরু হয়েছে অলৌকিক সব কাহিনি।
দুঃখের বিষয় হল, টেলিকাস্টিং-এর জগতে এক ইতিহাস তৈরি করলেও সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গেছে এই টেলিভিশন সিরিজটি। না আছে তার কোনো রেকর্ডিংস, না আছে ভয়েসওভারের ক্যাসেট। প্রামাণ্য নথি বলতে আজ শুধুমাত্র টিকে রয়েছে এই অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট এবং তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এ-সম্পর্কিত নানান সংবাদ। সাধারণ মানুষই বা ক’জন মনে রেখেছে এই সিরিজকে? এই সিরিজের প্রত্যক্ষদর্শীরাও হয়তো আর জীবিত নেই কেউ-ই।
Powered by Froala Editor