ঘরের এক কোণে শান্তভাবেই শুয়ে ছিল বিশাল চেহারার জার্মান শেফার্ড। অদূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন তার প্রভু তথা ট্রেনার। আলতো স্বরে নাম ধরে ডাকতেই লেজ নাড়তে নাড়তে উঠে পড়ল কুকুরটি (Dog)। তারপর তার দিকে তাকিয়ে ট্রেনার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ‘হু ইজ হিটলার’? উত্তর ভেসে এল ‘মেইনে ফুয়েরার’। আর উত্তরদাতা হল সেই পোষ্য জার্মান শেফার্ড (German Shephard)।
এ আবার হতে পারে নাকি? অবিশ্বাস জন্মানোটাই স্বাভাবিক। না, কোনো কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়, কোনো ম্যাজিক শো-এর কথাও হচ্ছে না। একেবারে বাস্তব ঘটনা। এ তো আর যে সে কুকুর নয়। খোদ নাৎসি বাহিনীর (Nazi) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কথা বলা কুকুর। হ্যাঁ, আজ থেকে সাত-আট দশক আগে এমনই ঘটেছিল জার্মানিতে। শুধু কথা বলাই নয়, শ্বাপদদের রীতিমতো পড়তে এবং লিখতেও শিখিয়েছিলেন জার্মানির নাৎসি গবেষকরা। কিন্তু কীভাবে?
শুধু গোলা-বারুদ আর আগ্নেয়াস্ত্র নয়, শত্রুপক্ষকে কাবু করতে অভিনব সব পন্থা আবিষ্কার করেছিলেন নাৎসি গবেষকরা। কখনও পরিকল্পনা ছিল মিত্রপক্ষের সৈনিকদের মধ্যে বিষ মেশানো খাবার বিতরণ করা, বিষাক্ত পোকা-মাকড়ের মাধ্যমে দুরারোগ্য রোগ ছড়ানো কিংবা জীবিত ইহুদি ব্যক্তির ওপরেই অমানবিক পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন তাঁরা। আর এইসব কাণ্ড-কারখানার পিছনে ছিল জার্মানির কুখ্যাত সামরিক বিভাগ বাফেন-এসএস। কুকুরকে কথা বলানোর পিছনে ছিল তাঁদেরই কৃতিত্ব।
তখনও বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়নি। তবে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন বাফেন এসএস-এর গবেষকরা। তাঁদের ধারণা ছিল বুদ্ধির নিরিখে প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র কুকুরই মানুষের সমতুল্য। ফলত, যুদ্ধে কেবলমাত্র বোমা চিহ্নিতকরণ নয়, বরং বিভিন্নভাবেই শত্রুপক্ষকে প্রতিহত করতে সাহায্য করতে পারে কুকুর। তবে তার সঙ্গে তো আগে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। তারা কথা বলতে না শিখলে, কীভাবেই বা আর শত্রুর ব্যাপারে সতর্ক করতে সৈনিকদের?
আরও পড়ুন
পেশা নাৎসি-শিকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বাস্তব ‘অ্যাভেঞ্জার’-রা
ফলত, শুরু হল প্রস্তুতি। জার্মানির বিভিন্ন অংশ থেকেই পুলিশ ও সেনাবিভাগের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরদের নিয়ে আসা হত গবেষণাগারে। তারপর চলত বিশেষ তথাকথিত এই ‘শিক্ষিত’ কুকুরদের পঠনপাঠনের ক্লাস। হিটলার নিজেও ছিলেন একজন সারমেয়প্রেমী। ফলে, এই গবেষণায় ঢালাও অর্থবিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। শুধু কুকুর ট্রেনিং-এর জন্য বিশেষ এসএস ইনস্টিটিউটও গড়ে উঠেছিল নাৎসি জার্মানিতে।
আরও পড়ুন
৭ হাজারেরও বেশি শিশুকে নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন ‘দ্বিতীয় মা’
তো সে যাই হোক, আপাতত ফেরা যাক কুকুরের কথা বলা প্রসঙ্গে। অবলা প্রাণীর মুখ দিয়ে যে মানুষের কণ্ঠস্বর বার করা সম্ভব নয়, তা ভালোই বুঝেছিলেন গবেষকরা। ফলত বিকল্প এক পন্থাকেই বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা। বানিয়েছিলেন কুকুরদের কথা বলার বিশেষ এক যন্ত্র। দেখতে অনেকটা সুইচ বোর্ডের মতোই। তাতে ছিল গোটা তিরিশেক আলাদা আলাদা সুইচ। প্রতিটি সুইচ চাপলেই আগে থেকে মানুষের কণ্ঠস্বরে রেকর্ড করা কথা বেরিয়ে আসত সেখান থেকে। কী প্রশ্নের উত্তরে ঠিক কী সুইচ চাপতে হবে— তার বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল কুকুরদের।
আরও পড়ুন
নাৎসিদের হাতে লুঠ হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধে, নিলামে ভ্যান গঘের আঁকা সেই ছবিই
তবে শুধু সুইচ বোর্ডই নয়। ছিল কুকুরদের কথা বলানোর একাধিক পন্থা। উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে বিষয়টা। ভাষার প্রতিটি বর্ণকে জার্মান গবেষকরা প্রতিস্থাপন করেছিলেন সংখ্যা দিয়ে। যেমন, ‘এ’-এর অর্থ ১। আবার ‘বি’-এর অর্থ ২। এভাবেই গোটা বর্ণমালা শেখানো হয়েছিল কুকুরদের। কোনো কুকুর একটানা তিনবার যদি ডাকে তবে ধরে নিতে হবে ‘সি’। তারপর খানিক থেমে পাঁচবার ডাকলে ‘ই’। এভাবেই সম্পূর্ণ শব্দ ও বাক্য গঠন করার ট্রেনিং পেয়েছিল নাৎসি শ্বাপদরা। আর তার ফলাফল ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক। শুধু কথা বলাই নয়, বরং রোলফ নামের একটি আয়ারডেল টেরিয়ার কবিতাপাঠও করতে পারত তার নিজের এই ভাষায়। আবার মাট নামের একটি জার্মান শেফার্ড জানত একাধিক ভাষা। যার মধ্যে ছিল ইংরাজি, ফ্রেঞ্চ।
জার্মান গবেষকদের মূল লক্ষ্য ছিল, বিভিন্ন ইহুদি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মানুষের পরিবর্তে কুকুর-প্রহরীর ব্যবহার শুরু করা। তবে তা আর হয়ে ওঠেনি। গবেষণা যখন সাফল্য পায় তখন ইতিমধ্যেই বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে একটু একটু করে পিছু হটতে শুরু করেছে জার্মানি। তবে গবেষণা যাতে শত্রুপক্ষের হাতে না পৌঁছায় তাই শেষের দিকে সমস্ত গবেষণাগারই ধ্বংস করে দিয়েছিলেন বাফেন এসএস-এর গবেষকরা। নির্মমভাবে মেরে ফেলা হয়েছিল পোষ্য প্রাণীগুলিকে। হিটলার নিজেও আত্মহত্যা করার আগে তাঁর প্রিয় জার্মান শেফার্ড ব্লন্ডিকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন বাঙ্কারে। এই ব্লন্ডিও নাকি ছিল অত্যন্ত শিক্ষিত ও মার্জিত সারমেয়।
বাফেন এসএস-এর সেইসব অদ্ভুত গবেষণার অধিকাংশই আজও অজানা সকলের কাছে। তবে এখনও নিরলসভাবেই তার অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন ঐতিহাসিকরা। আর সেই অনুসন্ধানে মাঝেমধ্যেই পুরনো নথি পরীক্ষায় উঠে আসে সেই সব অজানা ইতিহাস। তা চমকে দেওয়ার মতোই। একুশ শতকের প্রথম দশকে ঠিক সেভাবেই সামনে এসেছিল কথা বলার কুকুরের এই রহস্য। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ জান বন্ডেসন রহস্যোদ্ঘাটন করেছিলেন এই ইতিহাসের। ২০১১ সালে কথা-বলা কুকুরের ওপর তাঁর বিস্তারিত গবেষণা প্রকাশিত হয় গ্রন্থের আকারে। কিন্তু তাও যেন সন্দেহ থেকে যায় নাৎসি বিজ্ঞানীদের এইসব নথির ওপরে। তবে বছর দুয়েক আগে ২০১৯ সালে, বন্ডেসনের গ্রন্থের ওপরে নির্ভর করে এক যন্ত্র তৈরি করেন সান দিয়েগোর এক তরুণী। তারপর পোষ্য বুলডগ স্টেলাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টাও করেন তিনি। অবাক করার বিষয় হল, বোর্ডের সুইচ টিপে কথা বলার কৌশল বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করে ফেলেছিল স্টেলা। যুক্তরাষ্ট্রের তরুণীর এই গবেষণাই প্রমাণ করে দেয়, ভুয়ো ছিল না নাৎসি গবেষকদের দাবি…
Powered by Froala Editor