তর্কের জবাব দিতেন না ‘বৌঠাকরুন’, কাদম্বরীর কাছে রবীন্দ্রনাথের হার ছিল অবশ্যম্ভাবী

সূর্যস্নান।।  পর্ব ৫।।

কলিকাতা-নিবাসী শ্যামলাল গাঙ্গুলির মেয়ে কাদম্বরীর বয়স তখন নয় বছর। পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে, শ্যামলা রঙের স্নিগ্ধ সুন্দরী মেয়েটিকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়ির বধূ করে আনলেন। সেই দিনটা ছিল ২৩ আষাঢ়, ১২৭৫ বঙ্গাব্দ, ইংরাজি হিসাবে ৫ জুলাই, ১৮৬৮ সন। পাত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বয়স তখন উনিশ। আর, আমাদের রবির বয়স সাত কি আট। বাড়িতে তিনি ছিলেন একমাত্র দেওর, বউদিদিদের আমসত্ত্ব-পাহারা থেকে শুরু করে নানারকম খুচরো কাজের সঙ্গী। কাদম্বরীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে, রবির জীবনে এক নতুন পর্ব শুরু হল।

মন কেমন করা সুরে সানাই বাজছিল সেদিন। বাড়িতে এসে উঠলেন নতুন বৌ, তাঁর কচি শ্যামলা হাতে সরু সোনার চুড়ি। রবির মনে হল, এ যেন "চেনাশোনার বাহির সীমানা থেকে মায়াবী দেশের নতুন মানুষ।" পরিচয় করার ইচ্ছে খুব, কিন্তু কাছে আসতে সাহস হয় না, দূরে দূরে ঘুরে বেড়ায় রবি। 

এই দিনগুলোর কথা মনে করে, বহু বছর পরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
"একদিন বাজল সানাই বারোয়াঁ সুরে। শুকনো ডাঙায় প্লাবন নেমে
ঢেকে দিল তার ফ্যাকাসে চেহারা।
বাড়িতে এলো নতুন বউ,
কচি বয়সের লাবণ্যে ঢলঢল।
কাঁচা-শামলা রঙের হাতে সরু সোনার চুড়ি।
মলিন দিনশ্রেণীর কালো-ছাপ লাগা পাঁচিল দু-ফাঁক হয়ে গেল জাদুমন্ত্রে,
দেখা দিল অপূর্ব দেশের অপরূপ রাজকন্যা।
ছম ছম করতে লাগল সন্ধ্যা,
কাঁপতে লাগল অদৃশ্য আলোয়।" 

আরও পড়ুন
‘কলোকী পুলোকী সিংগিল মেলালিং’ – স্বল্প স্কুলজীবনে এমনই আবৃত্তি শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ

ঠাকুরবাড়িতে তখনও চলছিল নবাবি কায়দা। দুই মহলে বাড়ি ভাগ করা - পুরুষদের বাস বাইরে, মেয়েরা থাকেন ভেতর-কোঠায়। ছাদের উপর ছোড়দিদি বর্ণকুমারী নতুন বৌকে পাশে নিয়ে বেড়ান, মনের কথা বলাবলি হয়। রবি কাছে যাবার চেষ্টা করলেই খেতে হয় দিদির ধমক! ছেলেদের দাগকাটা গণ্ডির বাইরে সেই পাড়া, তাই নতুন বৌঠানের সঙ্গে রবির ভালো করে আলাপ জমানো বড়োই দুষ্কর।

আরও পড়ুন
নিতান্ত ছেলেবেলাতেই শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ-চর্চা

স্মৃতিকাতর প্রৌঢ় কবি লিখেছেন,
"ঘুরে বেড়াই, সাহস হয় না কাছে আসতে।
ও দিকে থাকে অভাবনীয়, এ দিকে থাকে উপেক্ষিত!
রাত হয়ে আসে।
স্বরূপসর্দার হাঁক দিয়ে যায়।
ছেঁড়া শেলাই-করা দড়িতে ঝোলানো-মশারি;
তার ভিতরের আকাশ ভরে ওঠে
গোধূলিলগ্নের সিঁদুরি রঙে,
চেলির রাঙা অন্ধকারে।" 

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের নামে রাস্তা সুদূর ইজরায়েলে, বিশ্বকবির জন্মদিনে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ইজরায়েলের

তবে, বালকের এই দু:খ বেশিদিন রইল না। বৌঠাকরুনের জায়গা হল অন্দরমহলের ছাদের লাগোয়া ঘরে, আর সেই ছাদের পুরো দখল পেলেন তিনি।
সেখানে পড়ত পুতুলের বিয়ের ভোজের পাতা। নেমন্তন্নের দিনে প্রাধান্য পেত ছেলেমানুষ রবি। নতুন বৌঠানের রান্নার হাত ছিল চমৎকার, রেঁধে খাওয়াতে তিনি বড়ো ভালোবাসতেন। আর সেই শখ মেটাতে তিনি এই বালক দেবরটিকে হাজির পেতেন। ইস্কুল থেকে ফেরার পরেই রবির সামনে তৈরি থাকত বৌঠানের আপন হাতের প্রসাদ। চিংড়িমাছের চচ্চড়ির সঙ্গে অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে যেদিন পান্তাভাত মেখে দিতেন, সেদিন তো আর কথাই ছিল না।

আরও পড়ুন
আন্না তরখর থেকে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো - রবীন্দ্রনাথে মুগ্ধ নারীদের গল্প

অতি সামান্য উপকরণের রান্নাতেও তাক লাগিয়ে দিতে পারতেন নতুন বৌঠান। রবির পৈতের সময় তিনি গাওয়া ঘি সহযোগে হবিষ্যান্ন রেঁধে দিয়েছিলেন, সেই তিনদিনের খাওয়ার স্বাদ আর গন্ধ কবি কখনও ভুলতে পারেননি। জ্যোতিদাদা কাছারিতে গেলে তাঁর জন্য জলযোগের ব্যবস্থা করে পাঠাতেন গৃহলক্ষ্মী। ফলের খোসা ছাড়িয়ে যত্ন করে কেটে রূপোর রেকাবিতে সাজাতেন তিনি, তার সঙ্গে থাকত নিজের হাতে তৈরি করা খানকয়েক মিষ্টান্ন, ওপরে ছড়ানো হত গোলাপের পাপড়ি। গেলাসে থাকত ডাবের জল, অথবা ফলের রস, অথবা বরফে ঠান্ডা করা কচি তালশাঁস। অতি সামান্য ব্যাপারেও বৌঠাকরুনের শিল্পীস্বভাব আর নৈপুণ্য প্রকাশ পেত। 

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই তাঁকে নিয়ে সংকলন; স্পনসর আইনস্টাইন, রোমাঁ রোলাঁ

ঘরের লাগোয়া ছাদটাকে কাদম্বরী একেবারে বাগান বানিয়ে তুলেছিলেন। খেয়ালি মানুষ, ছাদ জখমের কথা মনেই আনেন নি। পিল্পের ওপরে বসানো হয়েছিল সারি সারি লম্বা পাম গাছ, আশেপাশে চামেলি গন্ধরাজ করবী দোলনচাঁপা। এই বাগানের নাম দেওয়া হয়েছিল "নন্দন কানন"। সেকালের অনেক শিল্পী সাহিত্যিকের জমায়েত ঘটত এই নন্দন কাননে, আড্ডার পাশাপাশি চলত বৌঠাকরুনের হাতের জাদুকরী রান্নার আস্বাদন। 

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের কোনো ‘রবীন্দ্রনাথ’ ছিল না, ভাগ্যিস!

বৌঠানের সঙ্গ ছাড়া একদিনও চলত না রবির। মাঝে-মাঝে তিনি যখন আত্মীয়-বাড়িতে যেতেন, ইস্কুল-ফেরত রবি ঘরের সামনে বৌঠানের চটিজুতোজোড়া দেখতে না পেয়ে দারুণ রাগ করত। ঘর থেকে কোনও একটা দামী জিনিস লুকিয়ে রেখে ঝগড়ার পত্তন করত সে। কাদম্বরী ফেরার পর এই নিয়ে গণ্ডগোল বাধত, রবি বলত, "তুমি গেলে তোমার ঘর সামলাবে কে। আমি কি চৌকিদার।" বৌঠান রাগ দেখিয়ে বলে উঠতেন, "তোমাকে আর ঘর সামলাতে হবে না, নিজের হাত সামলিয়ো।" চাবি চুরি করা রবির এক প্রিয় খেলা ছিল। প্রায়ই চাবি লুকিয়ে রেখে কাদম্বরীকে ক্রুদ্ধ ও ব্যতিব্যস্ত করে তুলে মজা পেত সে। 

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের বড়দা তিনি, অগোছালো, পাণ্ডুলিপির ছেঁড়া পাতা ছড়িয়ে থাকত জোড়াসাঁকোয়

তর্কে কাদম্বরীর কাছে বরাবর হেরেছে রবি। তর্কের বিষয়ও কম ছিল না, মেয়েদের পোশাকের ফ্যাশন থেকে আরম্ভ করে খাঁচায় পাখি পোষার যৌক্তিকতা, সব কিছু নিয়েই রবির কিছু না কিছু বক্তব্য ছিল। কিন্তু শেষ অবধি তাকে হারতেই হত, কারণ বৌঠাকরুন তর্কের জবাব দিতেন না। আরেকটি ব্যাপারেও রবির হার অনিবার্য ছিল, সেটি হচ্ছে দাবা খেলা। সে খেলায় কাদম্বরীর হাত ছিল পাকা। 

নিতান্ত অল্পবয়সে কবির মাতৃবিয়োগ হয়, তখন আদরে-যত্নে বৌঠাকরুনই রবি সহ অন্যান্য বালকদের ভার নিয়েছিলেন। খাইয়ে-পরিয়ে আদরে-যত্নে তিনি তাদের জননীর অভাব ভুলিয়ে রাখার জন্য দিবারাত্র সচেষ্ট ছিলেন। কবি পরে অকপটে স্বীকার করেছেন, "শিশুকাল থেকে আমার জীবনের পূর্ণ নির্ভর ছিলেন তিনি।" 

তা বলে বৌঠাকরুন ও দেবরের অম্লমধুর কলহ কোনওদিনই থেমে থাকেনি। রবির গায়ের রং, চেহারা, গানের গলা, লিখিয়ে হবার সম্ভাবনা, খাবার খাওয়ার কায়দা- সবকিছু নিয়েই কাদম্বরীর সরস ও সহাস্য টিপ্পনী লেগেই থাকত। অবুঝ কিশোর তখন ক্ষুব্ধ হতেন, লজ্জা পেতেন। পরে, প্রৌঢ় কবি বুঝেছিলেন, সেই সব পরিহাসের আড়ালে নিত্যদিন ছিল বৌঠানের সজাগ ও সযত্ন ভালোবাসা। 

নতুন বৌঠানের সাহচর্যেই নারীর পরিচয় পেয়েছিলেন কবি। সেই প্রীতি ছিল দুর্মূল্য। তাঁর সকল আবদারের ওই একটি স্থান ছিল- নতুন বৌঠান। ভবিষ্যত জীবনে, রহস্যপ্রিয় কবি বলেছেন, "আমাদের কালে মেয়ে বলে যেন কিছুই ছিল না। মেয়ে বলে যে কিছু আছে জগতে তা বুঝতেই পারতুম না।... এক যা বৌঠানের একটু আদরযত্ন পেয়েছি; ঐ একটি মেয়ের ভিতর দিয়েই মেয়েজাতকে চিনেছিলুম।" 

তাই, কাদম্বরী সম্পর্কেই তো স্মৃতিকাতর কবি বলতে পারেন,
"একদিন এই পথে চলেছিলে আমাদের পাশে
বক্ষ তব দুলিত নিঃশ্বাসে।
অঙ্গে অঙ্গে প্রাণ তব
কত গানে কত নাচে
রচিয়াছে
আপনার ছন্দ নব নব..."
জীবনের সেই প্রভাতবেলায়, কাদম্বরীই যে কবির কাছে "এ বিশ্বের বাণী মূর্তিমতী"!

Powered by Froala Editor