কলকাতা ছেড়ে একটু দূরের পুজোয় উঁকি দিলেই দেখা যায় জমজমাট মেলা। বিরিয়ানি, রোল-চাউমিন, কবিরাজির ভিড় নয়। বরং জিলিপি, বাদামভাজা, গুড়ের তক্তি, ঝুরিভাজা, গজা, কটকটি, জিভেগজা এসবেই জমে ওঠে পুজো। সেসব কিনে এনে বাড়িতে জমানোর প্রবণতাও কি পুরনো হয়ে গেছে খুব?
মেলার প্রায় ৯০ শতাংশ দোকানদাররাই আসেন বহু দূর থেকে। স্থানীয় প্রায় নেই বললেই চলে। বেশিরভাগই প্রান্তিক জেলার বাসিন্দা। এক মেলা শেষ হলে আরেক মেলার দিকে শুরু হয় তাঁদের যাত্রা। ‘পরিযায়ী’ বললেও খুব একটা ভুল হয় না তাঁদের। কিন্তু এই করোনার পরিস্থিতিতে কেমন আছেন তাঁরা? কীভাবে লড়ছেন আর্থিক মন্দার বিরুদ্ধে এই অসম লড়াই?
“অন্যবছর আগে থেকেই আমাদের জানানো হয়। এবছর তেমন কিছুই হয়নি। দু’বার গিয়েও ফিরে এসেছি মেলার ওখান থেকে। ওখান থেকে এখনও বলছে জানানো হবে। থানা থেকে, ওপর মহল থেকে ঠিক করে দেবে কতগুলো দোকান বসবে, কী না বসবে। কিন্তু কয়েকদিন পেরিয়ে গেল। এখনও কিছু খবর পাইনি আমরা। আমরা তো কমিটির ভরসাতেই দোকান দিই, এমনি তো গিয়ে বসতে পারি না”, জানালেন গুণধর হালদার।
অন্তত তিরিশ বছর ধরেই জড়িয়ে রয়েছেন এই ব্যবসার সঙ্গে। পুজোর এই সময়টা অন্যবছর গুলোতে কলকাতার পার্শ্ববর্তী বজবজে সুভাষ উদ্যানের মেলাতেই কেটে যায় তাঁর। শয়ে শয়ে আসা মানুষের ভিড় সামলেই ভাগ করে নেন আনন্দ। এবছর দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর সংশয়ের মধ্যে দিয়েই দিন কাটছে তাঁর। ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে উৎসব। এরপর আর ডাক আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবুও আশায় আশায় ঘর বুনছেন তিনি।
গুণধরবাবুর বাড়ি লক্ষ্মীকান্তপুরে ছোট্ট এক গ্রামে। উপকূলের কাছাকাছি হওয়ায় আমফান তছনছ করে দিয়ে গেছে সাজানো সংসার, ভিটেমাটি। জানালেন, বেশ কয়েকদিন গিয়ে থাকতে হয়েছিল কাছের প্রাইমারি স্কুলে। সেখানেই খাওয়া-দাওয়া, সামান্য মাথা গোঁজার ঠাঁই। তার ওপরেই উপার্জনে করোনা পরিস্থিতির কোপ। বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের সরকার সাহায্য এখনও এসে পৌঁছায়নি তাঁর কাছে, দুঃখের সঙ্গেই জানালেন প্রসিদ্ধ জিলিপি ব্যবসায়ী।
কিন্তু কীভাবে কেটেছে এই মাঝের দিনগুলো? গুণধরবাবুর কথায়, “জমানো টাকা ভাঙিয়েই সংসার চলছে কোনোমতে। রথের মেলা থেকে শুরু হয়। তারপর ঝুলন, শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় জল ঢালা এসব লেগেই থাকে। হুগলিতে ওই সময়টা পর পর তিনটে মেলে করে এসে তারপর সুভাষ উদ্যানে যাই দুর্গা পুজোয়। সেখান থেকে বেহালায় তরুণ সঙ্ঘের কালিপুজোয় দোকান দিই। তারপর সরকারপোলে জগদ্ধাত্রী পুজো করে এসে বজবজ কালীবাড়িতে রাসের মেলায় দোকান দিই। কিন্তু দুর্গা পুজো অবধি এবার একটা জায়গাতেও ব্যবসা করার সুযোগ হয়নি।”
কথার মধ্যেই মিশে যাচ্ছিল দীর্ঘশ্বাস। ঠিক কীভাবে দিন গুজরান করছেন তিনি, তা সত্যিই হয়তো বোঝার ক্ষমতা নেই কারোর। “হাতের কাজ জানি বলে তাও চলছে কোনোমতে। এখানে তো দোকান দেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। বাড়িতেই জিলিপি, গজা ভেজে ভেজে মাথায় করে নিয়ে বিক্রি করতে যাচ্ছি। ট্রেনও তো বন্ধ। সেভাবে বিক্রি নেই। দিন ৫০-৬০ টাকার বিক্রি হয় কখনো। কখনো হয় না। তাও শেষ একমাস এইভাবে বিক্রি করছি। তার আগে তো বাইরে বেরনোও নিষিদ্ধ ছিল। ঘরেতেই বসে থাকতে হত।”
জুন মাস থেকেই এই মেলার মরশুম শুরু হয়ে যায়। চলে সেই ফেব্রুয়ারি মাস অবধি। আর এই ক’মাসের বিক্রিতেই সারাবছরের সঞ্চয়। নিজের জমি নেই। মাঝের সময়টায় বসে না থেকে ভাগচাষি হিসাবেই কাজ করেন অন্যবছর। তবে করোনার সংক্রমণে এবার আর সেই সুযোগও আসেনি। আর ঝড়ে তো বিঘার পর বিঘা ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। সেই কাজ আসবেই বা কী করে?
লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে গুণধরবাবু একা নন। আরও তিন-চার জন এই একই পেশার মানুষ ঘুরে বেড়ান জেলায় জেলায়। তাঁদের অবস্থাও একইরকম। একদিকে যেমন বন্ধ উপার্জন। তেমনই অন্যদিকে ফুরিয়ে আসছে জমানো টাকাও। আগামী মেলাগুলোতে সুযোগ আসবে কিনা তাও অনিশ্চিত। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা। কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এই অভাবের স্রোত জানা নেই কারোর। তবে এ শুধুই খণ্ডচিত্র। দক্ষিণ ২৪ পরগণা বাদ দিয়েও হাওড়া, হুগলি, মেদিনীপুর সহ অন্যান্য জেলাগুলিতেও এমন হাজার হাজার পরিযায়ী ব্যবসায়ী রয়েছেন। যারা কেউ মেলায় বেলুন, কাঁচের চুড়ির দোকান দেন। কেউ বা কাপ-প্লেট, খেলনা। আবার কেউ উল্কি আঁকেন। তাঁরা কেমন আছেন? জানা নেই। জানতেও নেই কি? এসব গল্প, ভেজা কণ্ঠস্বর শুনে ফেললেই সত্যি হয়ে ওঠে মহীনের গান। ‘ভালো লাগে না/ লাগে না/ কোনো কিছুই...’
Powered by Froala Editor