সালটা ১৭৫২। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরের আকাশের মুখ সেদিন গম্ভীর। রাত থেকে অবিশ্রান্ত কেঁদে চলেছে সে। এমনকি সকালেও সে কান্নার বিরাম নেই। এমনই এক দিনে ব্রিস্টল শহরের এক প্রান্তে এক বস্তিতে জন্ম টমাস চ্যাটাটর্নের। জন্মের পরে বাবাকে দেখেনি। মা সামান্য রোজগারে সংসার-সীমান্তে নিত্যদিন এক অসম লড়াই চালাতেন। যার একমাত্র সাক্ষী ছিল ছোট্ট টমাস।
১৭৫৯ সাল। টমাসের বয়স যখন মাত্র সাত বছর, মায়ের হাত ছেড়ে সে বেড়িয়ে পড়ল ভাগ্য অন্বেষণে। আশ্রয় মিলল সেন্ট মেরী চার্চে। অর্থাভাবে পড়াশোনা হয়নি টমাসের। চার্চের ফাদারের উৎসাহেই পড়াশোনার প্রথম পাঠ শুরু হল তার। এই চার্চের মধ্যেই ছিল এক লাইব্রেরী, যেখানে টমাস খুঁজে পেল তার নিজস্ব জগৎ। চার্চের কাজে আর মন বসে না তার। সারাদিন বসে থাকে হাতে বাইবেল নিয়ে। কিছুদিনের মধ্যেই সে পড়ে ফেলল লাইব্রেরীর সমস্ত বই।
এর কিছুদিনের মধ্যেই চার্চের ফাদার খোঁজ পেলেন কিছু কবিতার। শিশু টমাসের লেখা। সেই সাত বছর বয়সেই টমাস হাতে পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকদের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করল। ছোট্ট কবি দাবি জানাল তার প্রাপ্য স্বীকৃতির। বদলে কপালে জুটলো নিছক ঘাড়-ধাক্কা অথবা অপমান। প্রকাশিত হল না 'On the last Epiphany.'
স্যার হোরেস ওয়ালপোল ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার রবার্ট ওয়ালপোলের সন্তান। তবে এরই পাশাপাশি আরও একটি পরিচয় ছিল তাঁর। তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ে ইংল্যান্ডের একজন প্রথম সারির লেখক, প্রত্নতাত্বিক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ঘটনাচক্রে স্যার হোরেসও জড়িয়ে পড়লেন নিতান্ত অখ্যাত এই টমাস চ্যাটাটর্নের সঙ্গে। ১৯৬২ সালে একটি চিঠি পেলেন স্যার হোরেস ওয়ালপোল। যেখানে এক কিশোর তাঁকে জানাচ্ছে, সেন্ট মেরী চার্চ থেকে সে একটি পুঁথি উদ্ধার করেছে। সে সেই পুঁথিটি স্যার হোরেসকে পাঠাচ্ছে তার সময়কাল নির্ণয়ের জন্য। পুঁথি দেখে স্যার ওয়ালপোলের চক্ষু চড়কগাছ। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় প্রতিটি সাহিত্য পত্রিকাতে প্রকাশিত হল সেই খবর - সেন্ট মেরী চার্চ থেকে উদ্ধার হয়েছে এক মহামূল্যবান পুঁথি। যার রচনার সময়কাল শেক্সপিয়রেরও কিছুকাল আগে।
আরও পড়ুন
‘বেঞ্চের ওপর ঐ ছাতাটি রয়েছে’ – তক্ষুনি লিখে দিলেন বিনয়; হারিয়ে গেছে সেই কবিতাও
আলোড়ন পড়ে গেল সমস্ত ইংরেজ পণ্ডিতদের মধ্যে। এই পুঁথি ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করবে নির্ঘাত। সবাই যখন এই আনন্দের মুহূর্তের জন্য অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছেন, তখন স্যার হোরেস আবার একটি চিঠি পেলেন। এটিও পাঠিয়েছে সেই কিশোর, যে তাকে মূল পুঁথিটি পাঠিয়েছিল। অর্থাৎ এই চিঠির প্রেরক হল কিশোর টমাস। বস্তুতপক্ষে সেদিন কিশোর টমাসের এই চিঠি সমস্ত ইংরেজ পণ্ডিতদের জল্পনা-কল্পনায় জল ঢেলে দিয়েছিল। আবার একইসঙ্গে জন্ম দিয়েছিল নতুন বিতর্কের। কারণ চিঠিতে দশ বছরের কিশোর টমাস দাবি করেছে এই পুঁথিটির রচয়িতা সে নিজে। এই খবর শোনা মাত্র সমস্ত ইংরেজ পণ্ডিতদের দল রে রে করে উঠলেন। একজন অশিক্ষিত, চার্চে মালির কাজ করা কিশোর লিখবে এরকম কাব্য! ছো!
সাল ১৭৭০। আত্মহত্যা করল টমাস। ইতিমধ্যে মাত্র আঠেরোটা বসন্ত পার করেছিল সে। পরবর্তীকালে জানা যায় সেদিনের সেই কাব্য ছিল কিশোর কবি টমাসের-ই রচনা। যদিও এটি রচনা করতে গিয়ে তাকে তিনশো বছরের পুরোনো শৈলী ধার করতে হয়েছিল।কিন্তু মাত্র দশ বছর বয়সে এই তার এই প্রতিভা ছিল এক কথায় অবিশ্বাস্য। যে কবি বারংবার নিজের পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকের লাঞ্ছনা অপমানের শিকার হয়েছিল। এই কাব্য ছিল সেই সব অপমান লাঞ্ছনার জবাব। সে এই রচনার মাধ্যমে দাবি জানিয়েছিল তার প্রাপ্য স্বীকৃতির। সুইসাইড নোটে সে একটি কথায় লিখে যায় - 'আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী ইংরেজি সাহিত্যের বর্তমান যুগের তথাকথিত মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতেরা।'
আরও পড়ুন
ভূমির কাছেই ফিরতে চেয়েছিলেন কবি বীতশোক ভট্টাচার্য
কে জানে, আজও এইরকম কতশত টমাস তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে আমাদের অজান্তেই হারিয়ে যায়। আমরা কি তার হিসেব রাখি?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
জেলবন্দি কবি ভারভারা রাও অসুস্থ, ভর্তি হাসপাতালে; যত্ন নেওয়ার নির্দেশ কোর্টের