কেসারিয়া বালামো আয়োনি/ পাধারোনি মারে দেশ…’
বয়স আনুমানিক সত্তর। মাথায় লাল পাগড়ি। মুখে এক অদ্ভুত হাসি। মায়ামাখা স্বরে গেয়ে চলেছেন এমনই সব গান। হাতে স্পন্দিত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী রাজস্থানি যন্ত্র কামাইচা। আর তার হৃদয়বিদারক আওয়াজের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে শিল্পীর কণ্ঠস্বর। রাজস্থানে জয়সলমির দুর্গের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গেছে এই ছবি। বেলেপাথরের লম্বা পাঁচিলের কোল ঘেঁষে একটানা গেয়ে চলা এই শিল্পীর গান শুনলে গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য।
দাপু খান। বিগত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরেই তিনি এভাবেই রাঙিয়ে রেখেছেন জয়সলমিরকে। বা বলা ভালো রাঙিয়ে রেখেছিলেন। কয়েকদিন আগে, নীরবেই বিদায় নিলেন তিনি। খানিকটা যেন নিষ্প্রাণ হয়ে গেল ‘সোনার কেল্লা’।
জয়সলমির থেকে প্রায় ১২৭ কিলোমিটার দূরে ফতেহপুর জেলার ভাদলি গ্রামে বেড়ে ওঠা তাঁর। আসল নাম দীপু খান হলেও জয়সলমিরের মানুষের কাছে দাপু হিসাবেই পরিচিত ছিলেন তিনি। পড়াশোনা মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। তবে বিদেশি পর্যটকদের ঝরঝর ইংরাজিতে নিজের ঐতিহ্যের কথা শোনাতে, এতটুকু হোঁচট খেতেন না দাপু খান।
তবে ভাদলিতে তাঁর গ্রামের বাড়িতে গেলে আশ্চর্য হয়ে যাবে যে কেউ। বেশ কয়েকটা বাড়ি যেন পাঁচিল দিয়ে আলদা করা রয়েছে সমগ্র গ্রাম থেকে। আসলে ক্লাস্টারের মধ্যেই বসবাস দাপু খানের পরিবারের। সব মিলিয়ে সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০ জন। ছোটোবেলা থেকেই জাতিভেদ এভাবেই আলাদা করে দিয়েছিল তাঁকে। যা থেকে আজও অব্যহতি মেলেনি পরিবারের। আঞ্চলিক রাজপুতদের চোখে মেরাসি মগনিয়ার গোষ্ঠী নিচু জাত। ধর্মে মুসলমান হলেও যে তাঁরা নাম রাখে হিন্দুদের মতো। পুজো করে ‘কার্নি মাতা’-র।
আরও পড়ুন
চলে গেলেন প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব ইব্রাহিম আলকাজি, ভারতীয় থিয়েটার হারাল এক অভিভাবককে
নিচু জাত বলেই প্রথাগতভাবে কোনো কাজেরই যোগ্য নয় তাঁরা। তাই বাধ্য তাঁদের হয়েই বেছে নিতে হয় সঙ্গীতকে। পথে, ঘাটে গান গেয়ে সামান্য অনুদানের ওপরেই নির্ভরশীল থাকতে হয় সারাটা জীবন। সেভাবেই পথে নেমেছিলেন দাপু খান। হাতে তুলে নিয়েছিলেন ‘সোল অফ দ্য ডেসার্ট’, কামাইচা। আর সেই গানের জোরেই যেন বিশ্বজয় করেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
চলে গেলেন বলিউডের 'মাস্টারজি', সরোজ খানের মৃত্যুতে শোকের ছায়া
কিন্তু এই ‘ভিক্ষা’-র ওপর নির্ভর করে সত্যিই কি পেট চলে? অধিকাংশ মগনিয়ার শিল্পীরাই তাই রাজস্থান ছেড়ে বাইরের শহরে চলে যাচ্ছেন কাজের খোঁজে। সত্তর-আশির দশক থেকেই শুরু হয়েছে এই ভাঙন। তবে হাজার কষ্টের মধ্যেও গানকে ছাড়েননি তিনি। নাম লেখাননি বাণিজ্যিক জগতেও। ফিরিয়েছেন দিল্লি কিংবা কোক স্টুডিয়োর মঞ্চও। আসলে তাঁর কাছে জয়সলমির, গাদিসার লেক, পাটোয়া হাভেলিই সব— তাই রাজস্থান ছেড়ে কোথাওই যাননি দাপু খান। ১২৭ কিলোমিটার পথ পেরিয়েই পৌঁছে যেন শুধু পথচলতি মানুষকে গান শোনাতে।
আরও পড়ুন
চলে গেলেন বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ও সাহিত্যিক ডঃ আনিসুজ্জামান
জয়সলমির দুর্গে এই ধরণের বহু লোকশিল্পীর দেখাই মেলে। তবে দুর্গের পরিধির মধ্যে একমাত্র সঙ্গীত পরিবেশন করতেন তিনিই। শুধুমাত্র এইটুকু সহায়তা পেয়েছিলেন স্থানীয় প্রশাসনের জন্য।
মগনিয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে অনেকটাই মিল রয়েছে বেদের। হ্যাঁ, মুখে মুখে গল্পের ছলেই বেঁচে থাকে এই সংস্কৃতি, গান, লোকশিল্প। বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মগনিয়ার শিল্পীরা বাণিজ্যিক সাফল্যের জন্য পাল্টে ফেলছে গানের পরিকাঠামো। কামাইচি ছেড়ে কোথাও হারমোনিয়ামের রিড ধরছেন তাঁরা। ব্যবহৃত হচ্ছে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রও। হারিয়ে যাচ্ছে পাঁচশো বছরেরও পুরনো প্রাচীন ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্য রক্ষার লড়াইটাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন দাপু খান। সব মিলিয়ে মগনিয়ার ভাষায় রয়েছে প্রায় হাজারটি গান। সবগুলোই কণ্ঠস্থ ছিল তাঁর। ৬ রাগ আর ৩৬ রাগিণী খেলা করত তাঁর উচ্চারণজুড়ে।
বছর কয়েক আগে একদল পর্যটকের দৌলতেই ইন্টারনেটে প্রকাশ্যে এসেছিল দাপু খানের সঙ্গীত। এককথায় তাকে মুগ্ধতা বলাই চলে। শুধু তাঁর গান শুনবে বলেই বহু মানুষ ছুটে যেতেন রাজস্থানে। জয়সলমিরে। জাতিগত বিভাজনের বেড়াজাল ভেঙে এভাবেই হয়ে কখন যেন তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বজনীন।
একটা গল্প বলে শেষ করা যাক। মেরাসি সংস্কৃতিতে প্রচলিত রয়েছে এক অদ্ভুত লোককথা। তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে বৈকি। তবে মেরাসিদের বিশ্বাস, তানসেন ছিলেন তাঁদেরই জনগোষ্ঠীর এক সদস্য। সেই লোককথা অনুযায়ী দাপু খানই তো তাঁর উত্তরসূরি। সেই লোককথা কতদিন নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে বৈকি। তবে ইন্টারনেট আর ডিজিটাল দুনিয়ার দৌলতেই ধরা থাকবে ‘সোনার কেল্লা’-র এক স্বর্ণযুগ। যেখানে প্রতিদিন বেলেপাথরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে, মাটিতে বসেই দরবারে বসতেন রাজা। আর তাঁকে ঘিরে বসে থাকত মুগ্ধ শ্রোতাদের দল…
Powered by Froala Editor