রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপরীতে সৎ সাংবাদিকতা, নোবেলে শান্তির ধ্বজা ওড়ালেন তাঁরাই

আজ থেকে ৬ বছর আগে ফিলিপাইনসে তখনও অনলাইন পোর্টাল নির্ভর সাংবাদিকতার সেভাবে প্রচলন হয়নি। আর এমন একটা সংবাদমাধ্যম আর কতটাই বা প্রভাব ফেলতে পারে? এমনটাই মনে করেছিলেন ফিলিপানসের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে। ২০১৫ সাল, সামনেই ফিলিপাইনসের নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী দুতার্তে। নির্বাচনের কিছুদিন আগেই তিনি মুখোমুখি হলেন র‍্যাপলার নামে একটি অনলাইন পোর্টালের। সদ্য তৈরি হওয়া পোর্টাল, বয়স তখন সবে ৩ বছর। আর সেখানেই সাক্ষাৎকারের মধ্যে তিনি বলে ফেললেন এক বিস্ফোরক কথা। ১৯৮০-র দশকে মেয়র থাকাকালীন দুতার্তে নিজে তিনজন ব্যক্তিকে খুন করেছিলেন। সেই মামলা আদালতে উঠেছিল ঠিকই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্দোষ সাব্যস্ত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নিজের মুখেই যখন স্বীকার করলেন, তখন তো আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

দুতার্তে ভেবেছিলেন এমন একটা কথায় তাঁর দেশে একটা বড়ো বিতর্ক তৈরি করা যাবে। আর তার ফলে নির্বাচনে কিছুটা সাহায্যই হবে। কিন্তু ইন্টারনেটের দৌলতে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা পৃথিবীতে। নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত দুতার্তে বিজয়ী হলেও তাঁর কথা তখন সবাই জেনে গিয়েছেন। আর সেইসঙ্গে চিনেছেন এক সাংবাদিককে। মারিয়া রেসা। আমেরিকা প্রবাসী এই মহিলা সাংবাদিকই দুতার্তের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন। এই সাক্ষাৎকার ছড়িয়ে পড়লে তাঁর বিরুদ্ধে কী ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নেমে আসতে পারে, সেটা খুব ভালোমতোই জানতেন। কিন্তু প্রকৃত সাংবাদিকতার অর্থই যে ঝুঁকি নেওয়া। রেসা যেন সেই মূল্যবোধের জীবন্ত প্রতীক হয়ে উঠলেন। এরপর একের পর এক মামলায় জড়িয়েছেন মারিয়া রেসা। পেয়েছেন বহু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। সেই সাংবাদিকের সাহসিকতাকেই এবার সম্মান জানাল নোবেল কমিটি। ২০২১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন মারিয়া রেসা। তাঁর সঙ্গেই এই পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছেন রাশিয়ার সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাটোভ।

দিমিত্রি মুরাটোভ অবশ্য একেবারে প্রথাগত ধারায় কাগজে ছাপা সংবাদপত্র সম্পাদনা করেন। তাঁর পত্রিকার নাম ‘নোভায়া গেজেটা’। ১৯৯৫ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে এই পত্রিকা। এর আগে অবশ্য একাধিক সংবাদপত্রে কাজ করেছেন তিনি। তারও আগে রাশিয়ায় বলসেভিক যুগে তিনি ছিলেন রেড-আর্মির একজন সেনানী। তবে ক্রমশ তাঁর মনে হয়, মানুষের কাছে সঠিক খবর পৌঁছাচ্ছে না। আর সেই খবর পৌঁছে দেওয়াই একজন সচেতন নাগরিকের সবচেয়ে বড়ো কাজ। ১৯৯৫ সালে এই উদ্দেশ্যেই তৈরি করে ফেললেন ‘নোভায়া গেজেটা’। সম্বল বলতে মাত্র ২টি কম্পিউটার, ২ কামরার একটি অফিস এবং একটি প্রিন্টিং মেশিন। এগুলোও কেনার সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভ কিনে দিয়েছিলেন এই সরঞ্জামটুকু। এরপর শুধুমাত্র সৎ সাংবাদিকতার জোরেই আজ রাশিয়ার প্রথমসারির দৈনিক হয়ে উঠেছে এই পত্রিকা। এবং আন্তর্জাতিক স্তরে রাশিয়ার খবরের জন্য সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সূত্রও এই পত্রিকা। তবে এর পিছনের লড়াইটাও সহজ নয়। ২০০০ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বহু সাংবাদিক খুন হয়েছেন রাশিয়ায়। তার মধ্যে ‘নোভায়া গেজেটা’-র সাংবাদিকের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ৬ জন সাংবাদিক খুন হয়ে গিয়েছেন অতর্কিতে। সন্দেহ করা হয় প্রতিটা খুনের পিছনেই প্রশাসনের হাত রয়েছে।

অন্যদিকে মারিয়া রেসাকেও বহুবার মামলায় জড়াতে হয়েছে। ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিতর্কের পরেই তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়ো কর-ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়। অবশ্য রায়দানের আগেই সেই মামলা প্রত্যাহারও করা হয়। ২০১৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়ো সংবাদ প্রচারের অভিযোগ আনেন এক চিনা ব্যবসায়ী। সেদিন সারা পৃথিবীর মানবাধিকার রক্ষাকর্মীরা মারিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপরেও ৬ বছর পর্যন্ত কারাবাসের শাস্তি হয়েছিল তাঁর। অবশ্য মারিয়াকে জেলবন্দি করার আগেই আন্তর্জাতিক চাপে সেই মামলা প্রত্যাহার করেন সেই চৈনিক ব্যবসায়ী।

এভাবেই নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকতা করে যাচ্ছেন মারিয়া রেসা বা দিমিত্রি মুরাটোভের মতো মানুষরা। আর তাই আজও মানুষের কাছে সত্যি খবরটা পৌঁছে যেতে পারছে। সারা পৃথিবীজুড়ে যখন রাষ্ট্রীয় অনুশাসন এক ভয়ঙ্কর ফ্যাসিবাদী চেহারা নিতে চলেছে, তখন এমন সাহসী সাংবাদিকদেরই আরও বেশি করে প্রয়োজন। হতে পারে তাঁদের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য রয়েছে। একজন পুরোপুরি বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী, অন্যজন উদারনৈতিক মতবাদের প্রচারক। কিন্তু দুজনেই সৎ সাংবাদিকতার কাছে দায়বদ্ধ। দায়বদ্ধ মানুষের বিশ্বাসের কাছে।

Powered by Froala Editor