আকাশে একটু একটু করে জমছে মেঘ। সূর্যও ঢেকে গেছে প্রায়। ঝড় শুরু হওয়ার আগে বাড়ির দরজা জানলা বন্ধ করতে যাচ্ছেন নায়ক। ঠিক মন বসল না তাঁর; দাঁড়িয়ে পড়লেন দরজার পাশে। একসময় হাওয়ার তেজ বাড়তে শুরু করল, চারিদিক অন্ধকার করে এল, ঝড়ের দাপটে জানলাও খুলে গেল। আর নায়ক বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়? আনমনে তাকিয়ে আছেন সেই বৃষ্টির দিকে; শুরু হল গান ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন…’
বৃষ্টি এলে হাজারো গানের ভিড়ে এই গানটিও জায়গা করে নিয়েছে বাঙালির তরুণ মনে। ‘শেষ পর্যন্ত’ সিনেমার গান; কণ্ঠে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর কলমে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। এসবের বাইরেও পর্দায় এই গানটিকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন যিনি, এই কাহিনি তাঁকে নিয়ে। বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অথবা কেবলই ‘বিশ্বজিৎ’। বাঙালির আরও এক প্রেমিক নায়ক; যার মিষ্টি হাসি ও প্রাণবন্ত অভিনয়ে মেতে উঠেছিল সবাই…
বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের জীবনও নাটকের মঞ্চের থেকে কম ছিল না। প্রথমে বাংলা, পরে বলিউড— সমস্ত জায়গায় নিজের ছাপ রেখে এগিয়ে গেছেন তিনি। আর এই মানুষটাকেই একদিন বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল অভিনয়কে ভালোবাসার জন্য। তখন বিশ্বজিৎ একদম তরুণ। গড়পারের মামাবাড়িতে থাকতেন তিনি। প্রচণ্ড কড়া, রক্ষণশীল পরিবার। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকেও বাঙালি পরিবারে সিনেমা-নাটক নিয়ে বেশ নাক সিঁটকানো ব্যাপার ছিল। কিন্তু বিশ্বজিতের জীবনে তো ঢুকে গেছে সেই ছন্দ। শুরুটা হয়েছিল নাটক দিয়ে। রংমহলে থিয়েটারে কাজ করতেন, পেতেন সামান্য কিছু টাকা।
একদিন বাড়ি ফিরে মেকআপ তুলছেন; হঠাৎ দেখেন পেছনে মামাতো বোন দাঁড়িয়ে। এতদিন পরিবারকে লুকিয়ে অভিনয় করে এসেছেন; এবার জেনে গেলে তো…! বোনকে খুব করে বললেন বিশ্বজিৎ, যাতে সে কাউকে না বলে। কিন্তু, নিয়তি! বোন গিয়ে বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দিল। সেদিনই বাড়িছাড়া বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের। অভিনয়ের ছায়াও যেন বাড়িতে না পড়ে। রংমহলের ওই কটা টাকাই সম্বল। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন, বন্ধুর বাড়ির ছারপোকা-ভর্তি বিছানায় রাত কাটিয়েছেন পরবর্তীকালের নায়ক বিশ্বজিৎ। ১৯৫৮ সালে ‘কংস’ সিনেমায় প্রথমবার নামেন, কৃষ্ণের ভূমিকায়। সেখান থেকেই শুরু। তারপর ষাটের দশকে একের পর এক সিনেমায় অভিনয় করা। উত্তমকুমারের সঙ্গে বাঙালি পেল আরও এক মিষ্টি হাসির নায়ককে। যিনি রূপ, দক্ষতা ও ক্যারিশ্মা দিয়ে দর্শককে মাতিয়ে রাখবেন…
রেডিওতেও নাটক করেছেন বিশ্বজিৎ। আর সেই কাজ করতে করতেই মুম্বইয়ের সঙ্গে যোগসূত্র। আকাশবাণীতে চলছে নাটক ‘সাহেব বিবি গোলাম’। বিশ্বজিতের সঙ্গে রয়েছেন তৃপ্তি মিত্র। সেই নাটকের সূত্রেই আলাপ হল গুরু দত্ত, গীতা দত্তদের সঙ্গে। গুরু দত্ত মুগ্ধ হলেন এই বাঙালি তরুণটির কাজে। ঠিক করলেন, হিন্দি সিনেমায় তৈরি করবেন এই নাটকটি; আর নায়ক? সেখানে বিশ্বজিৎকেই চাই। অথচ, ছবিটি আর করা হয়নি তাঁর। ১৯৬২ সাল। ‘দাদাঠাকুর’ মুক্তি পেয়েছে বাংলায়। ছবি বিশ্বাসের শেষ ছবিতেও নিজের উপস্থিতি অক্ষুণ্ণ রাখলেন বিশ্বজিৎ। কিংবদন্তি ছবি বিশ্বাসের এমনই স্নেহ ছিল এই তরুণ অভিনেতাটির ওপর, যে রাতে নিজে উঠে বিশ্বজিতের গায়ে চাদর দিয়ে, মশারি টাঙিয়ে দিয়েছিলেন; যাতে মশা এসে ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটাতে পারে…
’৬২-তেই বলিউডে অভিষেক ঘটল তাঁর ‘বিশ সাল বাদ’ সিনেমার মাধ্যমে। তারপর আর থামতে হয়নি। লড়াইয়ের সেই দিনগুলো হয়তো মনে আসছিল তাঁর। যে করেই হোক, বলিউডে প্রতিষ্ঠা পেতে হবে। সেজন্য শিখেছেন ঘোড়ায় চড়া, বক্সিং, উর্দু— সব। আর বাংলাতেও একইভাবে সাবলীল তিনি। ‘দুই ভাই’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ থেকে শুরু করে ঋত্বিক ঘটকের তথ্যচিত্র ‘দুর্বার গতি পদ্মা’-তেও ছিল তাঁর দৃঢ়, উজ্জ্বল উপস্থিতি। তাঁর চারপাশে তখন তারাদের ঝিকিমিকি। তার মধ্যেই নিজের জায়গাটুকু করে নিয়েছিলেন বিশ্বজিৎ। তৈরি হয়েছিল স্নেহের সম্পর্কও। এমনই সে সম্পর্ক যে, ছেলে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের অন্নপ্রাশনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে অতিথি আপ্যায়ন করেছিলেন ছবি বিশ্বাস! উত্তমকুমার, কানন দেবী… কে না ছিলেন সেখানে! সেই দিন আজ অতীত। ৮৪-র বিশ্বজিৎ এখনও নিজের কাজ নিয়ে বেঁচে আছেন প্রবলভাবে। বেঁচে আছেন নিজের সৃষ্টির জগত নিয়ে…
আরও পড়ুন
‘ওকে একবার অভিনয়ের সুযোগ দিন’, বন্ধুর জন্য গুরুর পা পর্যন্ত ধরেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী
তথ্যসূত্র-
১) ‘এমন করে তো কেউ জানতে চায়নি কেন ওদের ছেড়ে গিয়েছিলাম’, সাক্ষাৎকার বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল রায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘বলিউডে প্রথম সারির পাঁচ নায়কের মধ্যে আমার নাম আসত’, সাক্ষাৎকার বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, পারমিতা সাহা, আনন্দবাজার পত্রিকা
Powered by Froala Editor